Sunday, August 28, 2011

মার্কসবাদীরা “বাম” শিবিরের যে সব শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে

পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইতে বিভিন্নধারার বাম শক্তি নানাসময়ে একসাথে লড়েছে, কখোনো লড়েছে একই সাথে রাষ্ট্র আর পরস্পরের বিরুদ্ধে। আর বিপ্লবের জন্য মার্কসবাদের দর্শনকে অন্যান্য অসর্বহারা দর্শনের বিরুদ্ধে লড়েই জনমনে নিজের মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। শুধু সংগঠনের বাইরে নয়, লড়তে হয় সংগঠনের ভেতরেও। ‘‘পার্টি তার ভেতরে ও বাইরে সংস্কারবাদ, সংশোধনবাদ, বিলোপবাদ, বুর্জোয়া উদারতাবাদ, নৈরাজ্যবাদ ও অন্যান্য সমস্ত অসর্বহারা ধ্যান ধ্যারণার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালায়।’’

রিফর্মইজম (সংস্কারবাদ)

এই ধারা বিপ্লবী ধারা ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারার মধ্যবর্তী হিসেবে গণ্য। এরা শ্রমিক আন্দোলনের ট্রেড ইউনিয়ন পথে বিশ্বাস করে যা রাষ্ট্র ও প্রচলিত শ্রেণিস্বার্থকে অক্ষুন্ন রেখে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে শোষিত শ্রমিকদের জন্য ধীরে ধীরে আইনী পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের জন্য সাফল্য হাসিল করে আনবে। সোস্যালিজমের জন্য বলপ্রয়োগের পরিবর্তে রিফর্ম এর কথাই এরা বলেন। অধিকাংশ সোসালিস্ট ও কমিউনিস্ট শক্তি রিফর্মিস্টদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালালেও সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে এই ট্রেডইউনিয়ন কার্যে যুক্ত থাকে। এই ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক হলেন বার্নস্টাইন (১৮৫০-১৯৩২)। এই জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এর মূল মতবাদ আছে তার বই ইভোলিউশনারি সোস্যালিজম (১৮৯৯) এ।

রিভিশনইজম (সংশোধনবাদ)

কোনো তত্ত্বের মূল বনিয়াদকে যখন অস্বীকার করা হয়, তখন তাকে রিভিশনইজম বলে। ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বদলালে তত্ত্বকে সমকালের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার থেকে এটা ভিন্ন, কারণ এখানে তত্ত্বের মূল বনিয়াদকেই আর স্বীকার করা হয় না।

· মার্কসীয় দর্শনের নিরিখে রিভিশনইজম এর প্রথম উদগাতা বার্ণস্টাইন। তিনি বলেছিলেন সমাজতন্ত্রের জন্য বলপ্রয়োগের দরকার নেই, তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন রিফর্ম এর দ্বারাই সম্ভব।

· স্ট্যালিন জমানায় যারা ভোগ্যপণ্য উৎপন্নর ওপর জোর দিয়েছিলেন তাদের রিভিশনিস্ট আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

· ১৯৫৬য় হাংগেরীর ওপর সোভিয়েত নীতির প্রতিবাদে অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন ইউরোপীয় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে দেন ও রিভিশনিস্ট হিসেবে সমালোচিত হন। এদের অন্যতম ই পি থমসন কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেন থেকে বিতাড়িত হবার পর নিউ লেফট রিভিউ বের করেন। ফ্রাংকফ্রুট স্কুলের লেখকরা – যেমন – হর্কহাইমার, অ্যাডোর্নো, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, হাবেরমাস, হার্বাট মার্কুইস এবং গ্রামশি, আলথুজার এই পত্রিকার মাধ্যমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

· ১৯৬০ এর দশক থেকে ক্রুসচেভ নীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি বারবার তাকে নয়া সংশোধনবাদী হিসেবে আখ্যা দেয়। ধনতান্ত্রিক দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নয়া সোভিয়েত নীতি তারা বাতিল করে।

· মাও সে তুং চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত শক্তিসমূহ বিভিন্ন দেশে রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে সংশোধনবাদী আখ্যা দেয় ও মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টিগুলির জন্ম হয়। ইউ এস এ, বলিভিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রিটেন, কানাডা, কলম্বিয়া, আয়ারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, পেরু, পর্তুগাল, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, গ্রীস, ইতালি, টার্কি, প্যারাগুয়ের মতো ভারতেও বিশ্ব রাজনীতির বিপ্লবী রাজনীতির ধারায় সি পি আই (এম এল) এর জন্ম হয়। (অন্যদিকে ইরাণ, নেপাল, ভুটান, টার্কি ছাড়া অন্য কোথাও ভারতের মতো মাওবাদী পার্টি তৈরি হয় নি।)

অ্যানার্কিজম (নৈরাজ্যবাদ)

সোস্যালিজমের উদগাতাদের মতোই অ্যানার্কিস্টরাও সমস্ত অর্থনৈতিক একচেটিয়াকরণের অবসান চায় আর মনে করে উৎপাদন সম্পর্ক ও ভূমির ওপর সর্বসাধারণের মালিকানা থাকা উচিৎ। ক্যাপিটালিজম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা মনে করে এর সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিৎ। সমস্তরকম কর্তৃত্বের বিরুদ্ধেই তাদের জেহাদ। সামাজিক সাম্যর পাশাপাশি সমস্তরকম কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জন এদের লক্ষ্য। অ্যানার্কিজমের মূল দুটি ধারা হল সোশ্যাল অ্যানার্কিজম ও ইন্ডিভিজুয়াল অ্যানার্কিজম। সোশ্যাল অ্যানার্কিজমের ধারাটি মনে করে সংগবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণিই পারে সমাজতন্ত্র আনতে। অন্যদিকে ইন্ডিভিজুয়াল অ্যানার্কিজমের ধারাটি মনে করে যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানই অ্যানার্কিজমের শত্রু। এর দুটি উপধারার একটি শিক্ষা ও সামাজিক চেতনা বৃদ্ধির অপর জোর দেয়। অন্য জংগী ধারাটি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ও সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। অ্যানার্কিস্ট তত্ত্বের প্রধান উদগাতাদের মধ্যে আছেন মিখাইল বাকুনিন (১৮১৭ -১৮৭৬)। তাঁর বিখ্যাত বই – গড অ্যান্ড দ্য স্টেট (১৮৭১) এবং মার্কসিজম ফ্রিডম অ্যান্ড দ্য স্টেট (১৮৭০-৭২)

কমিউনিস্টরা সবধরনের অ্যানার্কিস্টদের বিরুদ্ধেই তীব্র ও নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যায় কারণ এই অ্যানার্কিস্টরা জনবিচ্ছিন্ন এবং নিজেদের মতামত হিংসাত্মকভাবে জনগণের ওপর তারা চাপিয়ে দেয়। আর তার ফলে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, সরকারী দমননীতি তীব্রতর হয়, এবং এই দমননীতি জনগণকে ভীত করার ফলে সরকার বিপ্লবী শক্তিকে তুলনামূলক বেশি অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে যায়। যাবতীয় প্রতিষ্ঠান এবং কৌম্যের বিরোধিতার অ্যানার্কিস্ট অবস্থানটিও কমিউনিস্ট ইতিহাস ভাবনার বিরোধী। কারণ মানুষ সভ্যতার সূচনা থেকেই প্রয়োজনের তাগিদেই সমাজ গড়ে তুলেছে। আর শ্রমিকশ্রেণির মজবুত সংগঠনের ওপর দাঁড়িয়েই কমিউনিস্টরা পুঁজিবাদের উৎখাতের কথা ভাবে, ব্যক্তিহত্যার পথে নয়।

চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম প্রগতিশীল ইতিহাসকার রামশরণ শর্মা


প্রাচীন ভারত ইতিহাসচর্চার প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ত্ব রামশরণ শর্মা [জন্ম – ২৬ নভেম্বর, ১৯১৯, মৃত্যু - ২০ অগষ্ট, ২০১১] চলে গেলেন ৯২ বছর বয়েসে। শিক্ষক ও ইতিহাসকার হিসেবে তাঁর অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষ্য রয়েছে তাঁর লেখা শতাধিক গ্রন্থে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ইতিহাস এর অধ্যপনার পাশাপাশি তিনি পড়িয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো প্রতিষ্ঠানে। ভারতীয় ইতিহাস রিসার্চ কাউন্সিলের তিনি ছিলেন প্রতিষ্টাতা চেয়ারম্যান। মার্কসীয় বীক্ষায় প্রাণিত হয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুসন্ধান ও রচনার যে ধারা ডি ডি কোসাম্বীর মত ঐতিহাসিক ‘ভারতীয় ইতিহাসচর্চার ভূমিকা’র মতো বইতে তৈরি করে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার এর মতো রামশরণ শর্মার মত ইতিহাসবিদরা তাকেই আরো প্রসারিত করেছেন।

রামশরণ শর্মার লেখা বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল

  • প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রতিষ্ঠান
  • প্রাচীন ভারতে শূদ্র
  • ভারতের প্রাচীন ইতিহাস
  • আর্যদের সন্ধানে
  • ভারতের সামন্ততন্ত্র
  • আদি মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ
  • প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
  • ভারতে নগর অবক্ষয়

অন্তজ মানুষকে ইতিহাস অনুসন্ধানের কেন্দ্রে স্থাপন করে তাঁর লেখা ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’(১৯৫৮) ইতিহাসচর্চায় একটি নতুন যুগের সূচনা করে। অন্যদিকে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজ বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখালিখি ভারত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এর উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসকেও তিনি সামনে এনেছেন। তাঁর যে মতটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে সেটি হল ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও তার চরিত্র। ভারতে সামন্ততন্ত্রের সূচনা ড. শর্মার মতে মৌর্যত্তরকালে বিশেষত গুপ্তযুগে। তিনি সামন্ততন্ত্রের লক্ষণ বিচার করেছেন তিনটি আমল ধরে। বাংলা বিহারের পাল বংশ, গুর্জর-প্রতিহার এবং গুজরাটের রাষ্ট্রকূট শাখা। এই প্রসঙ্গে উঠেছে মোগল পূর্ব ভারতে জমিতে ব্যক্তিগত অধিকারের প্রসঙ্গ। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক সামন্ততন্ত্র ও তার অর্থব্যবস্থার উত্থান বিকাশ চরিত্র নিয়েও তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে আর্য সংক্রান্ত বিবাদের সময় বিশেষ যুক্তি ও তথ্য সহযোগে তিনি হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকদের মতগুলি খণ্ডন করছেন। তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন ভারতবর্ষই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। এর পেছনে ছিল বৈদিক ধর্মকে হিন্দু ধর্মের পূর্বসূরী ধরে নিয়ে তার মাহাত্ম্যপ্রচার ও সেই প্রচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। এই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে ‘লুকিং ফর দ্য এরিয়ানস’ (১৯৯৫) এবং তারপর ‘আর্যদের ভারতে আগমন’ (২০০১) বইতে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণের সাহায্যে সঠিক ইতিহাসকে সামনে এনেছেন। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করতে অযোধ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্যকে সামনে এনেছিলেন। বিষ্ণুস্মৃতি উদ্ধার করে তিনি দেখান সেখানে ৫২টি তীর্থস্থানের তালিকা থাকলেও তাতে অযোধ্যার কোনও উল্লেখ নেই। ১৫৭৪ এ তুলসীদাস তাঁর রামচরিতমানস এও অযোধ্যাকে তীর্থস্থান হিসেবে দেখান নি। ধর্মস্থান হিসেবে অযোধ্যার উত্থান অনেক পরবর্তীকালের ঘটনা। ভারত ইতিহাসচর্চায় তাঁর এক বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে ইরফান হাবিব সঠিকভাবেই বলেছেন, “ ড্যানিয়েল থর্ণার এবং ডি ডি কোশাম্বীর পাশাপাশি রামশরণ শর্মাই প্রথম ঐতিহাসিক হিসেবে কৃষককে ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বে অধিষ্ঠিত করেছেন।” সাম্প্রদায়িকতা, সামন্ততান্ত্রিকতা, বর্ণব্যবস্থা জর্জরিত ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের কালো দিকগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর তথ্যমূলক ও আলোকসম্পাতি ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক কর্মীদের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে।

Thursday, July 07, 2011

কুমায়ুন

কুমায়ুন

কুমায়ুনের পাহাড় ঘুরতে হলে যেখান থেকে শুরু করতে হয় সেটা নৈনিতাল। আমরা কোলকাতা থেকে রওনা দিয়ে প্রথমে নামলাম হলদোয়ানি। কাঠগোদামের আগের স্টেশন, কাঠগোদামের থেকে এখানেই ভাড়া গাড়ি বা বাস পাওয়া বেশি সুবিধের। আরেকটা রাস্তা লখনৌ থেকে মিটার গেজের ট্রেনে লালকুঁয়া গিয়ে সেখান থেকে নৈনিতাল। নৈনিতাল যেতে হলদোয়ানি থেকে দু ঘন্টার কিছু বেশি লাগবে, পাহাড়ি রাস্তায় এই ৩৯ কিমি যেতে তেমন কষ্ট হয় না। রাস্তা বেশ চওড়া, ভালো আর খুব পরিচ্ছন্ন। নৈনিতাল এ গিয়ে প্রথমেই মন ভরিয়ে দিল একটা মিষ্টি তিরতিরে ঠান্ডা। কোলকাতা যখন ৩৫ ডিগ্রী পেরিয়েছে, নৈনিতাল তখন ২৫ এর আশেপাশে, সন্ধ্যা, রাতে তো আরও খানিক কম। সন্ধ্যা অবশ্য গোটা কুমায়ুনেই বেশ দেরিতে নামে। সাড়ে সাতটারও পর। প্রথম দিন নৈনিতাল পৌঁছে হোটেলেই বিশ্রাম। কিন্তু সেটাও বেশ প্রীতিপ্রদ। আমরা ছিলাম হোটেলের তিনতলায়। সেখান থেকে নৈনি লেকের ভিউটা খুব চমৎকার। প্রায় সাত হাজার ফিট ওপরে এরকম বড় একটা লেক সত্যি দারুণ একটা ব্যাপার। লেকটা লম্বায় দেড় কিমি আর চওড়ায় পাঁচশো মিটার। লেকের ধারের রাস্তাটাই হার্ট অব নৈনিতাল। সার দিয়ে দোকান পাঠ আর সুন্দর সুন্দর পান্থনিবাস। রাস্তার একদিকের নাম তাল্লিতাল আর একদিকের মাল্লিতাল। মাল্লিতাল থেকে উঠে গেছে রোপওয়ে বা কেবল কার। অনেকটা ওপরে নিয়ে যাবে এই কেবল কার, সেখান থেকে দূরের বরফ মোড়া পাহাড় দেখা যায় শীতকালে গেলে। এই গরমে মেঘে ঢাকা সেই সব দূরের শৃঙ্গরা, কিন্তু তবু ওই ওপর থেকে নৈনির আর এক সুন্দর রূপ দেখে অনেকটাই মন ভরে যায়। নৈনি ছাড়াও আশেপাশে আছে আরো বেশ কিছু লেক বা তাল। যেমন ভীমতাল, খুরপাতাল। নৈনিতালের একটা উল্লেখযোগ্য জিনিস পাইন ফল আর বিশেষত মোমের তৈরি রকমারী জিনিসপত্র। বেশ সস্তায় সেসব কেনা হল পরিচিত বন্ধুজনেদের উপহার দেবার জন্য।

নৈনিতাল থেকে আমরা পাড়ি দিলাম আলমোড়া জেলার রাণীক্ষেতের দিকে। নৈনিতাল বেশ ভীড়ের জায়গা। তুলনায় সেনা রেজিমেন্ট এর শহর রাণীক্ষেত অনেকটাই ফাঁকা। উচ্চতা নৈনিতালের মতই। রাণীক্ষেতে যেটা সবচেয়ে মন টানে সেটা হল বিরাট গলফ কোর্স। আমরা হোটেল থেকে যখন গলফ কোর্স এর দিকে রওনা দিলাম ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা বেজেছে, কিন্তু বেশ তীব্র রোদ। দীর্ঘক্ষণ গলফ কোর্স এ ঘোরাঘুরি হল। সেনাবাহিনির অফিসাররা তখন চুটিয়ে গলফ খেলছেন। বল এসে আঘাত করতে পারে, বারবার আসা এই সতর্কতা উপেক্ষা করেই আমরাও চুটিয়ে সবুজ মখমলকে উপভোগ করেই চললাম একমনে। রাণীক্ষেতের চৌবাতিয়া উদ্যান আরেকটা উপভোগের জায়গা। কত নাম না জানা গাছ আর ফুলের যে সমারোহ পাহাড়ের গা কেটে কেটে তৈরি সেই বিশাল প্রাকৃতিক উদ্যানে। রাণীক্ষেতে কেনাকাটির জন্য আছে নানা রকমের শাল। বাজারে পাওয়া যায়, তবে সেখানে নাকি ঠকার আশঙ্কা। ভালো হয় সেনা পরিচালিত কমিউনিটি সেন্টার থেকে কেনাকাটি করলে।

আমাদের একটা আশা তখনো মেটেনি। সাদা বরফের টোপর পরা শৃঙ্গ তো চোখে পড়ল না। মেঘে ঢেকে আছে তারা। এ আপশোষ ভুলিয়ে দিল কৌশানি। রাণীক্ষেত থেকে উপত্যকা পেরিয়ে আবার পাহাড় চড়ে কৌশানি। উচ্চতা নৈনিতাল বা রাণীক্ষেতের মতই ৭০০০ ফিটের কাছাকাছি। কিন্তু হিমালয়ের সু উচ্চ শৃঙ্গরাজি দু চোখ ভরে দেখার এত ভালো ব্যালকনি আর হয় না। এখানে হোটেলের ঘর থেকেই দেখা মিলল দূরের নন্দাদেবীদের। বরফে ঢেকে থাকা এই পাহাড়চূড়োদের আর ভালভাবে দেখতে গেলে অবশ্য আসতে হবে শীতকালে। কৌশানিতে আলাদাভাবে দেখার কিছু নেই। চোখ মেলে চারিদিকে তাকিয়ে থাকাটাই কাজ। প্রকৃতি এত সুন্দর আর এত নির্জন যে তন্ময়তা অজান্তেই নেমে আসে। অনেকেরই জানা নেই রাতের আকাশ ভালোভাবে দেখার একটা চমৎকার জায়গা কৌশানি। টেলিস্কোপের সাহায্যে রাতের আকাশের গ্রহ তারা পরিষ্কার দেখা কৌশানি ভ্রমণের একটা অতিরিক্ত পাওনা। কৌশানি হিন্দি কবি সুমিত্রানন্দন পন্থ এর আবাসভূমি। আর এখানে অল্প কিছুদিন কাটিয়ে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। লিখেছিলেন গীতার অনাসক্তি যোগের ভাষ্য। গান্ধীবাসের সেই স্মৃতিমাখা অনাসক্তি যোগ আশ্রম এখন গান্ধী সংগ্রহশালা। রয়েছে গান্ধীজীর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি। সংগ্রহ করা যায় তাঁর লেখা বই। হিন্দি ইংরাজী তো বটেই, এমনকী বাংলা ভাষাতেও।

ভালো হত কৌশানি থেকে চৌকরি হয়ে যদি মুন্সিয়ারী যাওয়া যেত। ইচ্ছাও ছিল, কিন্তু সেটা এবার আর হোল না। দেখা যাক, আবার কবে সুযোগ মেলে। আপাতত কৌশানি থেকেই কাঠগোদাম হয়ে কোলকাতায় ফিরতে হল।

রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং ভারতরাষ্ট্রের চরিত্র

৬৪ কোটি টাকার বোফর্স কেলেঙ্কারি একটি সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। আর এখন আমরা প্রায় প্রতিদিনই লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ হতে দেখছি। এটা ঘটনা যে দুর্নীতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু আরো বড় কথা হলো আজকের দুর্নীতির চেহারাটাই উদারনৈতিক ও বিশ্বায়িত ভারতরাষ্ট্রের চেহারাটাকে প্রতিফলিত করছে। বৃহৎ পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদী সব সময়েই ভারতরাষ্ট্রকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় ও বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি ক্রমবর্ধমান হারে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরো প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করছে।

শাসকশ্রেণির রাজনীতিবিদরা কি কর্পোরেটদের দালাল ?

রাডিয়া টেপ দেখিয়ে দিয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি তাদের দালালদের মাধ্যমে কিভাবে মন্ত্রীদের নিয়োগ, সংসদের আইন পাশ এবং নীতিকে তাদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাজনীতি ও কর্পোরেট তহবিল এর আলিঙ্গন ক্রমশ বেড়েছে। কয়েকবছর আগে বিজেপির প্রমোদ মহাজন এবং সমাজবাদী পার্টির অমর সিং এর কথা শোনা যেত, যারা তাদের পার্টির জন্য কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক শো কোটি টাকা তুলে ফেলতে পারেন। এই কর্পোরেট দাক্ষিণ্য নিশ্চিতভাবেই প্রতি দক্ষিণার শর্তের সাথে যুক্ত। রাডিয়ারা কর্পোরেট লবির হয়ে যে কাজ করে দেন, যেমন এ রাজাকে টেলিকম মন্ত্রী বানানো, তা পরবর্তী উপকারের কথা মাথায় রেখেই। কর্পোরেটদের টাকা রাজনীতিবিদের পরিবারকে ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয়, আর সেই ঘুষের কালো টাকা পরিবারের মাধ্যমেই সাদা হয়। কর্পোরেটদের বিপুল টাকা যে সুবিধাজনক রিপোর্ট বা সুপারিশের জন্যই শুধু কাজে লাগে তা নয়, এ দিয়ে এমনকী বিচারপতিদেরও প্রভাবিত করা যায়। এই ছবিটা অমর সিং টেপ, প্রমোদ মহাজন ঘটনাবলীতে নিহিত ছিল এবং রাডিয়া টেপএ তার পরিপূর্ণ চেহারা বেরিয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় কথা বিভিন্ন আর্থিক এবং আভ্যন্তরীণ নীতি – এস ই জেড আইন, পেটেন্ট আইন, নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি আইন, বিভিন্ন কালা কানুন, অপারেশন গ্রীন হান্ট প্রভৃতি এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কিছু নীতিমালাও তৈরি হচ্ছে কর্পোরেট স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই।

উইকিলিকস যা প্রমাণ করেছে

রাজনৈতিক দুর্নীতির সবচেয়ে বড় প্রমাণ সম্ভবত সংসদে নিউক্লিয়চুক্তির সময় আস্থাভোটে টাকার বিনিময়ে সাংসদদের ভোট কেনাবেচার ঘটনাটি। উইকিলিকস এর এই সংক্রান্ত কেবল এর প্রকাশ ইউ পি এ সরকারের আস্থাভোটে জয়ের জন্য সাংসদ কেনাবেচার ব্যাপক অভিযোগটি শেষপর্যন্ত প্রমাণ করে দিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়দলই উইকিলিকস এর কেবল প্রকাশ এর ঘটনার গুরুত্বকে কমিয়ে দেখাতে সচেষ্ট। কেন কংগ্রেস নেতারা আমেরিকান কূটনীতিকদের বলতে গেলেন আস্থাভোটে জয়ের জন্য ভোট কেনার পরিকল্পনার কথা, আর কেনই বা তাদের ট্রাঙ্ক ভর্তি টাকা দেখালেন? এর স্পষ্ট কারণ একটাই। তাদের আমেরিকি প্রভুদের এটা দেখিয়ে তারা নিশ্চিন্ত করতে চেয়েছিলেন, ইউ পি এ সরকার আস্থাভোটে জিতে যাতে নিউক্লিয় চুক্তি করতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করণীয় তারা তা করছেন।

মন্ত্রীসভার আমেরিকাপন্থী অদলবদল

উইকিলিকস এর কেবলগুলি প্রকাশ করে দিয়েছে ভারতের আর্থিক ও বিদেশনীতির ওপর, এমনকী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমেরিকার প্রভাব কতটা। ৩০জানুয়ারী ২০০৬ পাঠানো আমেরিকান দুতাবাসের কূটনীতিক ডেভিড সি মালফোর্ড এর কেবলবার্তা অনুসারে দেখা যাচ্ছে তিনি লক্ষ্য রাখছেন ২০০৬ এর জানুয়ারীতে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিং সরকার নিযুক্ত করছে (কেবল এর মতে) আমেরিকাপন্থী মুরলী দেওরাকে, সরিয়ে দিচ্ছে মনী শঙ্কর আইয়ারকে, যিনি (কেবল এ) বর্ণিত হচ্ছেন ইরাণ পাইপলাইন এর উচ্চকিত প্রস্তাবক হিসেবে। মালফোর্ড এও বলেছেন “দেওরা সহ সাংসদদের একটা বড় অংশ আমাদের রণনৈতিক সমঝোতার সঙ্গে প্রকাশ্যেই যুক্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে সাতজন ভারত আমেরিকা যৌথ সংসদীয় মঞ্চের সদস্য”। মন্ত্রীসভার অদল বদল প্রসঙ্গে মালফোর্ড এই বলে উপসংহার টানছেন, “ভারত এবং ইরাণে এটা আমেরিকার লক্ষ্যের সঙ্গে ভীষণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ” এবং এটা মনমোহন সিং সরকারের “ভারত আমেরিকা সম্পর্কের দ্রুত অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে দৃঢ়তার প্রমাণ”।

আমেরিকা নির্দেশিত আর্থিক নীতিমালা

প্রকাশিত কেবলবার্তা যেমন দেখিয়ে দিচ্ছে ভারতের আর্থিক নীতির ওপর আমেরিকার নিবিড় নজরদারী ও নিয়ন্ত্রণ এর দিকটি, তেমনি প্রকাশ করছে ভারতের মন্ত্রীরা বিভিন্ন কর্পোরেশনকে কেমন সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছেন সেই দিকটিও। একটি কেবল বার্তায় আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিন্টন ভারতের অর্থমন্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাইছেন, “মুখার্জী (প্রণব) কোন শিল্প বা বাণিজ্য গোষ্ঠীর কাছে দায়বদ্ধ এবং কাদের তিনি আর্থিক নীতির মাধ্যমে সুবিধা পাইয়ে দেবেন?’’ আমরা কি এরকমই অর্থমন্ত্রী চাই, যিনি ভারতের সাধারণ মানুষের পরিবর্তে বিভিন্ন কর্পোরেট গোষ্ঠীর কাছে দায়বদ্ধ? হিলারী ক্লিন্টনের কেবল এটাও দেখিয়ে দেয় মন্ত্রীদের থেকেও আমেরিকাপন্থী আর্থিক নীতি রূপায়ণে আমেরিকার কাছে যিনি বেশি বিশ্বস্ত, তিনি হলেন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর মতোই যিনি কিনা আই এম এফ দ্বারা নিযুক্ত। হিলারী প্রশ্ন করেছেন, “মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়ার পরিবর্তে মুখার্জীকে কেন অর্থমন্ত্রীর পদে বসানো হল?’’

বিদেশনীতির আমেরিকাপন্থী রূপান্তর

অন্যান্য কেবলগুলি দেখিয়ে দিচ্ছে ইজরায়েল এবং ইরাণ এর সঙ্গে তার সম্পর্কর প্রকৃত চেহারা নিয়ে ভারত সরকার তার জনগণের কাছে মিথ্যাচার করেছে। একটি কেবল এরকম মনে করেছে ইরাণের সাথে দৃশ্যত ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক আসলে ‘লোকদেখানো, মূলত দেশের মুসলিম জনসমাজ এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অংশকে খুশি রাখার চেষ্টা’। আরেকটি কেবল তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণনকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছে দ্বিতীয়বার আই এ ই এ তে বিষয়টি আসার সময়ে ইরাণের বিরুদ্ধে ভারতের ভোট দেবার ভাবনার কথা, কিন্তু ভয় আছে দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক আধারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে।

আমেরিকার কেবলবার্তার নথি অনুসারে ভারতকে আমেরিকার প্রতিনিধি সতর্ক করে জানাচ্ছেন আই এ ই এ তে ইরাণের বিরুদ্ধে ভারতের ভোট দেবার ব্যর্থতা নিউক্লীয় চুক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। ঘটনাবলী দেখিয়ে দিয়েছে মনমোহন সিং সরকার তাদের আমেরিকি প্রভুর নির্দেশানুযায়ীই ভোট দিয়ে তাদের সেবা করেছেন।

নিশ্চিতভাবেই ফাঁস হওয়া কেবল বার্তা জীবন্ত ও বিস্ফোরক সব প্রমাণ হাজির করেছে। শুধুমাত্র ঘুষের বিষয়টিই নয়, বরং আমেরিকার স্বার্থ রক্ষার তাগিদে ভারতের নিজের স্বার্থহানি ঘটানো এবং গণতন্ত্রকে বিপন্ন করার মতো আরো গভীর অভিযোগই এতে যুক্ত।

বিজেপি – কর্পোরেট ও আমেরিকি প্রভুদের অনুগত

প্রধান বিরোধী দল বিজেপি রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপকে তুলে ধরতে বা প্রতিরোধ করতে একেবারেই আগ্রহী নয়। বস্তুতপক্ষে বিজেপি সহ সব শাসক দলই কর্পোরেট পক্ষপাতদুষ্ট। কর্পোরেটদের সত্যিকারের কোন ক্ষতি করবে, এরকম কোন কিছু করতে তারা আদৌ প্রস্তুত নয়। রাডিয়া টেপ এরকম অনেক ঘটনা তুলে ধরেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে বিজেপির উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বও বাধ্যের মতো কর্পোরেট স্বার্থর সেবা করেছেন।

উইকিলিকস বিজেপির দ্বিচারিতাকে প্রমাণ করে দিয়েছে। আমেরিকার ইচ্ছার কাছে মাথা নত করার ক্ষেত্রে কংগ্রেস বিজেপি এক গোয়ালেরই গরু। বিজেপির একজন বরিষ্ঠ নেতৃত্বকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে তিনি আমেরিকার প্রতিনিধিকে আশ্বস্ত করে জানাচ্ছেন আমেরিকার অধীনতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিজেপির করা ইউ পি এ সরকারের সমালোচনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেবার দরকার নেই। এটা ইউ পি এ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু সমর্থন আদায় করে নেবার জন্য রাজনৈতিক ভাষণ মাত্র। আর একটি কেবলের সূত্র অনুযায়ী লালকৃষ্ণ আদবানী নিউক্লিয় চুক্তি বিষয়ে বিজেপির সরকারী বক্তব্যকে খাটো করে দেখাচ্ছেন আর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বিজেপি ক্ষমতায় এলে ইন্দো আমেরিকি সম্পর্ক, এমনকি নিউক্লিয় চুক্তিকে পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। আরেকটি কেবলবার্তা দেখাচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে আমেরিকা ভিসা না দেওয়ায় অরুণ জেটল ক্রুদ্ধ হয়ে বলছেন যে তিনি কিছুতেই এটা বুঝে উঠতে পারছেন না, যে পার্টি ইন্দো আমেরিকি সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের কাজ শুরু করল তার নেতা সম্পর্কে আমেরিকা কিভাবে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একই কেবলে জেটলি খুচরো ব্যবসা ও আইনি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করছেন। আমেরিকান দূতাবাসের আধিকারিক মন্তব্য করেছেন যে মোদিকে ভিসা দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি ছাড়া ঐ সাক্ষাৎকারে জেটলি আগাগোড়া আমেরিকার সঙ্গে ব্যক্তিগত ও অর্থনীতিগত সংযোগ স্থাপনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন।

লোকের কাছে জাতিয়তাবাদী সাজলেও আসলে বিজেপি যেমন আমেরিকার সাথে গাঁটছড়া বাঁধতেই দায়বদ্ধ, তেমনি দুর্নীতি বিরোধী লোকদেখানো ভড়ং থাকলেও নব্যউদারনৈতিক অর্থনীতি ও কর্পোরেট ভজনায় সে নিবেদিত প্রাণ।

ইউ পি এ র আমেরিকাপন্থী নীতির বিরুদ্ধে বিজেপির তথাকথিত স্বদেশীর মুখোশ উইকিলিকস কেবল খুলে দিয়েছে। তাদের হিন্দুত্ব রাজনীতিও সুযোগসন্ধানী বলে প্রমাণিত হয়েছে। জেটলি নিজেই সাক্ষাৎকারে হিন্দুত্ব রাজনীতিকে সুবিধাবাদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আমেরিকার প্রতিনিধিকে জেটলি বলেছেন, “উদাহরণ হিসেবে ভারতের উত্তর পূর্ব কে নেওয়া যায়। সেখানে হিন্দুত্ব ভালো তাস, কারণ লোকের মনে বাংলাদেশ থেকে মুসলিম অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত ভীতি আছে। ভারত পাকিস্থান সম্পর্কের অধুনা উন্নতি হিন্দু জাতিয়তাবাদী রাজনীতিকে দিল্লিতে এখন কিছুটা গুরুত্বহীন করে দিয়েছে, কিন্তু সীমান্তের ও পার থেকে পার্লামেন্ট হামলার মত কোন ঘটনা ঘটলেই সেটা পালটে যেতে পারে।” এসব কথা দেখিয়ে দেয় পার্লামেন্ট আক্রমণের মত ঘটনাও বিজেপির কাছে কাঙ্ক্ষিত, কারণ তা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্য উর্বর জমি তৈরি করে।

অনৈতিক গণতন্ত্র ?

এখনো অবধি সবচেয়ে জঘণ্য দুর্নীতির ঘটনায় তাঁর নিজের কর্পোরেট হাউসের লবিইস্ট নীরা রাডিয়া জড়িয়ে যাওয়ার পর রতন টাটা নেমেছেন আহত শহীদের ভূমিকায় অভিনয় করতে। একটি মিডিয়া হাউসের ‘ওয়াক অ্যাণ্ড টক শো’ তে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার সম্পাদক শেখর গুপ্তর সাথে কথা বলার সময় তিনি জানিয়েছেন, বিশ্বরঙ্গমঞ্চে প্রবেশে জন্য ওবামা ভারতকে প্রশংসা করলেও তখন থেকে ভারত কর্ণি ক্যাপিটালিজম (সরকারী আধিকারিকদের মদতপুষ্ট পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতি) ও ব্যানানা রিপাবলিক (দুর্নীতিপরায়ণ গণতন্ত্র, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি সম্পর্কে প্রযুক্ত হত কথাটি) এ পরিণত হবার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। টাটা যখন কর্ণি ক্যাপিটালিজম বা সরকারী আধিকারিকদের মদতপুষ্ট পুঁজিপতিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির কথা বলছিলেন, সেই কর্পোরেট লবিইস্ট এর কথা কি বলছিলেন, যিনি মন্ত্রী, সরকার ও বিরোধী পক্ষ, বিচারক ও সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের তাঁর আঁচলের তলায় রেখেছেন? যখন তিনি দুর্নীতিপরায়ণ গণতন্ত্রর কথা বলছিলেন, তিনি কি তখন সরকার ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তাপুষ্ট সেইসব অতি ধনী কর্পোরেট হাউসের কথা বলছিলেন, যারা শাস্তির ভয়মুক্ত হয়ে আইন ভাঙে, গণতন্ত্রকে অস্বীকার করে, দেশের অমূল্য সম্পদ লুঠ করে? ঠিক যেরকম দুর্নীতি পরায়ণ গণতন্ত্র গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে? না, এসব টাটা বলছিলেন না। তিনি বলছিলেন একজন কর্পোরেট লবিইস্ট এর ফোন ট্যাপ হওয়া এবং তার ‘ব্যক্তিগত’ কথা মিডিয়ায় ফাঁস হবার কথা। তিনি বোঝাতে চাইছিলেন অন্য কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানীর স্বার্থে টাটার ভাবমূর্তি ম্লান করার কথা।

টাটা সতর্কবাণী দিয়েছেন, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো তথাকথিত গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদির নামে যদি আমরা গণতন্ত্রবিলাস এর অপব্যবহার করি’, তবে ভারত এমন একটা দেশে পরিণত হবে, যেখানে মানুষ ‘যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই জেলে যাবে বা তাদের দেহ গাড়ির ট্রাঙ্কে পাওয়া যাবে। এটা কৌতূহলজনক ব্যাপার যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সাধারণভাবে গণতন্ত্রকেই টাটা বিলাস বলে উল্লেখ করেছেন। সিঙ্গুরের কৃষক বা কলিঙ্গনগরের আদিবাসীরা সেই জগৎ সম্পর্কে টাটাকে শেখাতে পারে, যেখানে জমি অধিগ্রহণের মত স্বার্থবাহী বিষয়ে শক্তিশালী কর্পোরেটদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে বিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘যথোপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই জেলে যেতে হয়’, জমিতে মরে পড়ে থাকতে হয় অথবা পুলিশের গুলি খেয়ে মরে যেতে হয়। টাটার দৃষ্টিতে কৃষক ও আদিবাসী জনগণের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে কৃষি জমি রক্ষার লড়াই, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হল গণতান্ত্রিক বিলাস। অন্যদিকে টাটার মত ধনকুবেররা উপভোগ করবেন ব্যক্তিগত গোপনিয়তার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং আদালতে গিয়ে ব্যক্তিগত গোপনিয়তার নামে প্রমাণ লোপের চেষ্টা করবেন।

বস্তুতপক্ষে রাডিয়া টেপ এবং উইকিলিকস এর ফাঁস হওয়া তথ্যাবলী দেখায় যে ভারত ইতোমধ্যেই অনৈতিক গণতন্ত্র বা ব্যানানা রিপাবলিক হবার রাস্তায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এখানে কর্পোরেট ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি কর্পোরেট স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে গণতন্ত্র ও জনাধিকারকে ধ্বংস করছে। যদি অবিলম্বে নব্যউদারনৈতিক নীতিসমূহকে পালটানো না যায় তা হলে অচিরেই ভারত একটি ব্যানানা রিপাবলিক বা অনৈতিক গণতন্ত্র হয়ে উঠবে। দক্ষিণ আমেরিকার পূর্বতন ব্যানানা রিপাবলিকগুলি এক নতুন জাগরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে জনপ্রিয় সরকার ও আন্দোলনগুলি সাম্রাজ্যবাদের শক্তিশালী ভূমিতে দাঁড়িয়েই তাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ভারত তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সম্পদের সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন, আমাদের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের বিপদের প্রশ্নে নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে সংকল্পবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন।

কর্পোরেট লুঠকে সাহায্য করতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস

সারা দেশ জুড়েই সরকারের সাহায্যে কর্পোরেটদের দ্বারা চলছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি ও জঙ্গল দখল। দখল চলছে খনি, আবাসন ও অন্যান্য নানা ধরণের প্রজেক্ট ও শিল্প স্থাপনার জন্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে জমি আইনকে ভাঙা হয়েছে, আর সরকারি আধিকারিকরা চোখ বুজে থেকেছেন। কিন্তু এই কর্পোরেটকুল মদত পেয়েছে পুলিশি লাঠি গুলি আর দানবীয় আইনের। যারাই একে প্রশ্ন করতে গেছেন, তাদের পড়তে হয়েছে ব্যাপক নিপীড়ণের মুখে।

আদিবাসী ও কৃষক সম্প্রদায় জমি হারানোর মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। কলিঙ্গনগর, জগৎসিঙ্ঘপুর, দাদরি, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, সোমপেটা, শ্রীকাকুলাম – সর্বত্রই তারা মুখোমুখি হয়েছেন পুলিশের নির্মম লাঠি গুলির। পুলিশি নিপীড়ণ ও সংগঠিত রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়ে অনেকে হতাহত হয়েছেন। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে অধিকাংশ জনপ্রিয় আন্দোলনই মাওবাদী ঘরাণার ছিল না, বরং ছিল জনতার সংগ্রাম। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী সবাইকেই ‘মাওবাদী’ তকমা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আদিবাসীরা তাদের আবাসভূমি জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন। ছত্তিশগড়ে মাওবাদী দমনের নামে ‘সালওয়া জুডুম’ নামধারী বাহিনী মাওবাদী দমনের নামে জোর করে হাজার হাজার আদিবাসীকে উচ্ছেদ করছে, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে।

মাওবাদী দমনের নামে কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক অপারেশন গ্রীন্ট হান্ট নামক সেনা হামলা নামিয়ে এনেছে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে মাওবাদের বাহানায় কর্পোরেট লুঠের স্বার্থে এটা আসলে গণপ্রতিরোধ আর প্রতিবাদী কন্ঠস্বরকেই নিশানা করেছে। বিনায়ক সেনের মত যারা কর্পোরেট লুঠ আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নীতির বিরোধিতা করেন, তাদের প্ররোচনাদাতা, সন্ত্রাসবাদীদের সমপর্যায়ভুক্ত বলে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিনায়ক সেন সেইসব হাজার হাজার কর্মী ও সাধারণ মানুষেরই একজন, যিনি কর্পোরেটদের সম্পদ হরণের ঘটনাকে প্রশ্ন করায় কালা কানুনে বন্দী হয়ে জেলে গেছেন।

এটা মনে রাখা দরকার অপারেশন গ্রীন হান্ট নামিয়ে এনেছেন যে চিদাম্বরম, তিনি নিজেই ২০০৪ এ অর্থমন্ত্রী হবার আগের দিন পর্যন্ত বহুজাতিক মাইনিং কোম্পানী বেদান্ত এর অধিকর্তা ছিলেন।

চিদাম্বরমএর লোক সুপারিশ করেছেন কর্পোরেট এলাকাভুক্ত সেনাবাহিনীর

চিদাম্বরমের লক্ষ্য ও ভাবনাচিন্তা প্রকাশিত হয়েছে মাহিন্দ্রার বিশেষ পরিষেবার সি ই ও রঘুরামনের কথায়। এই রঘুরামন আবার চিদাম্বরমের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের পেটোয়া প্রজেক্ট ন্যাটগ্রিড এর মাথা, যারা গোয়েন্দা তথ্যাবলী সংযোজন করে। একটি রিপোর্ট এর রঘুরামন আশ্চর্যজনকভাবে তার সুপারিশে বলেছেন, কর্পোরেটদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পা দেওয়ার সময় এসে গেছে। এই ভাবনার সমর্থনে তিনি আমেরিকা, ইজরায়েল এবং অন্যান্য দেশের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন কর্পোরেটদের নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া হোক। বলেছেন ব্যবসায়ী সম্রাটরা যদি এখনই তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য রক্ষায় এগিয়ে না আসে, তাহলে তাদের হয়ত দেখতে হবে তাদের সাম্রাজ্যর সীমারেখা ভেঙে যাচ্ছে।

কর্পোরেটদের নিজেদের নিজস্ব সেনাবাহিনী রাখা আর দূরের কোন কষ্টকল্পনা নয়। বস্তার, রায়গড়া, সিঙ্গুর বা জগৎসিঙ্ঘপুরে শাসক রাজনৈতিক দলের সহায়তায় কর্পোরেটরা প্রতিবাদীদের ভয় দেখানো ও জোর করে কাজ হাসিল করার জন্য নিজস্ব সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়েই নিয়েছিল। অপারেশন গ্রীন হান্টও একটা এমন দৃষ্টান্ত যেখানে ভারতের পুলিশ ও আধাসেনাকে কর্পোরেট সম্রাটদের সাম্রাজ্য রক্ষায় ব্যবহার করা হচ্ছে।