Sunday, August 28, 2011

মার্কসবাদীরা “বাম” শিবিরের যে সব শক্তির বিরুদ্ধে লড়ে

পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াইতে বিভিন্নধারার বাম শক্তি নানাসময়ে একসাথে লড়েছে, কখোনো লড়েছে একই সাথে রাষ্ট্র আর পরস্পরের বিরুদ্ধে। আর বিপ্লবের জন্য মার্কসবাদের দর্শনকে অন্যান্য অসর্বহারা দর্শনের বিরুদ্ধে লড়েই জনমনে নিজের মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। শুধু সংগঠনের বাইরে নয়, লড়তে হয় সংগঠনের ভেতরেও। ‘‘পার্টি তার ভেতরে ও বাইরে সংস্কারবাদ, সংশোধনবাদ, বিলোপবাদ, বুর্জোয়া উদারতাবাদ, নৈরাজ্যবাদ ও অন্যান্য সমস্ত অসর্বহারা ধ্যান ধ্যারণার বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালায়।’’

রিফর্মইজম (সংস্কারবাদ)

এই ধারা বিপ্লবী ধারা ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারার মধ্যবর্তী হিসেবে গণ্য। এরা শ্রমিক আন্দোলনের ট্রেড ইউনিয়ন পথে বিশ্বাস করে যা রাষ্ট্র ও প্রচলিত শ্রেণিস্বার্থকে অক্ষুন্ন রেখে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে শোষিত শ্রমিকদের জন্য ধীরে ধীরে আইনী পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের জন্য সাফল্য হাসিল করে আনবে। সোস্যালিজমের জন্য বলপ্রয়োগের পরিবর্তে রিফর্ম এর কথাই এরা বলেন। অধিকাংশ সোসালিস্ট ও কমিউনিস্ট শক্তি রিফর্মিস্টদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালালেও সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে এই ট্রেডইউনিয়ন কার্যে যুক্ত থাকে। এই ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক হলেন বার্নস্টাইন (১৮৫০-১৯৩২)। এই জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এর মূল মতবাদ আছে তার বই ইভোলিউশনারি সোস্যালিজম (১৮৯৯) এ।

রিভিশনইজম (সংশোধনবাদ)

কোনো তত্ত্বের মূল বনিয়াদকে যখন অস্বীকার করা হয়, তখন তাকে রিভিশনইজম বলে। ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বদলালে তত্ত্বকে সমকালের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার থেকে এটা ভিন্ন, কারণ এখানে তত্ত্বের মূল বনিয়াদকেই আর স্বীকার করা হয় না।

· মার্কসীয় দর্শনের নিরিখে রিভিশনইজম এর প্রথম উদগাতা বার্ণস্টাইন। তিনি বলেছিলেন সমাজতন্ত্রের জন্য বলপ্রয়োগের দরকার নেই, তা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে শান্তিপূর্ণ বিভিন্ন রিফর্ম এর দ্বারাই সম্ভব।

· স্ট্যালিন জমানায় যারা ভোগ্যপণ্য উৎপন্নর ওপর জোর দিয়েছিলেন তাদের রিভিশনিস্ট আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

· ১৯৫৬য় হাংগেরীর ওপর সোভিয়েত নীতির প্রতিবাদে অনেক বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন ইউরোপীয় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে দেন ও রিভিশনিস্ট হিসেবে সমালোচিত হন। এদের অন্যতম ই পি থমসন কমিউনিস্ট পার্টি অব গ্রেট ব্রিটেন থেকে বিতাড়িত হবার পর নিউ লেফট রিভিউ বের করেন। ফ্রাংকফ্রুট স্কুলের লেখকরা – যেমন – হর্কহাইমার, অ্যাডোর্নো, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, হাবেরমাস, হার্বাট মার্কুইস এবং গ্রামশি, আলথুজার এই পত্রিকার মাধ্যমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

· ১৯৬০ এর দশক থেকে ক্রুসচেভ নীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি বারবার তাকে নয়া সংশোধনবাদী হিসেবে আখ্যা দেয়। ধনতান্ত্রিক দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নয়া সোভিয়েত নীতি তারা বাতিল করে।

· মাও সে তুং চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত শক্তিসমূহ বিভিন্ন দেশে রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে সংশোধনবাদী আখ্যা দেয় ও মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টিগুলির জন্ম হয়। ইউ এস এ, বলিভিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রিটেন, কানাডা, কলম্বিয়া, আয়ারল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, পেরু, পর্তুগাল, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, গ্রীস, ইতালি, টার্কি, প্যারাগুয়ের মতো ভারতেও বিশ্ব রাজনীতির বিপ্লবী রাজনীতির ধারায় সি পি আই (এম এল) এর জন্ম হয়। (অন্যদিকে ইরাণ, নেপাল, ভুটান, টার্কি ছাড়া অন্য কোথাও ভারতের মতো মাওবাদী পার্টি তৈরি হয় নি।)

অ্যানার্কিজম (নৈরাজ্যবাদ)

সোস্যালিজমের উদগাতাদের মতোই অ্যানার্কিস্টরাও সমস্ত অর্থনৈতিক একচেটিয়াকরণের অবসান চায় আর মনে করে উৎপাদন সম্পর্ক ও ভূমির ওপর সর্বসাধারণের মালিকানা থাকা উচিৎ। ক্যাপিটালিজম এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা মনে করে এর সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিৎ। সমস্তরকম কর্তৃত্বের বিরুদ্ধেই তাদের জেহাদ। সামাজিক সাম্যর পাশাপাশি সমস্তরকম কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জন এদের লক্ষ্য। অ্যানার্কিজমের মূল দুটি ধারা হল সোশ্যাল অ্যানার্কিজম ও ইন্ডিভিজুয়াল অ্যানার্কিজম। সোশ্যাল অ্যানার্কিজমের ধারাটি মনে করে সংগবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণিই পারে সমাজতন্ত্র আনতে। অন্যদিকে ইন্ডিভিজুয়াল অ্যানার্কিজমের ধারাটি মনে করে যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানই অ্যানার্কিজমের শত্রু। এর দুটি উপধারার একটি শিক্ষা ও সামাজিক চেতনা বৃদ্ধির অপর জোর দেয়। অন্য জংগী ধারাটি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ও সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। অ্যানার্কিস্ট তত্ত্বের প্রধান উদগাতাদের মধ্যে আছেন মিখাইল বাকুনিন (১৮১৭ -১৮৭৬)। তাঁর বিখ্যাত বই – গড অ্যান্ড দ্য স্টেট (১৮৭১) এবং মার্কসিজম ফ্রিডম অ্যান্ড দ্য স্টেট (১৮৭০-৭২)

কমিউনিস্টরা সবধরনের অ্যানার্কিস্টদের বিরুদ্ধেই তীব্র ও নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যায় কারণ এই অ্যানার্কিস্টরা জনবিচ্ছিন্ন এবং নিজেদের মতামত হিংসাত্মকভাবে জনগণের ওপর তারা চাপিয়ে দেয়। আর তার ফলে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, সরকারী দমননীতি তীব্রতর হয়, এবং এই দমননীতি জনগণকে ভীত করার ফলে সরকার বিপ্লবী শক্তিকে তুলনামূলক বেশি অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে যায়। যাবতীয় প্রতিষ্ঠান এবং কৌম্যের বিরোধিতার অ্যানার্কিস্ট অবস্থানটিও কমিউনিস্ট ইতিহাস ভাবনার বিরোধী। কারণ মানুষ সভ্যতার সূচনা থেকেই প্রয়োজনের তাগিদেই সমাজ গড়ে তুলেছে। আর শ্রমিকশ্রেণির মজবুত সংগঠনের ওপর দাঁড়িয়েই কমিউনিস্টরা পুঁজিবাদের উৎখাতের কথা ভাবে, ব্যক্তিহত্যার পথে নয়।

চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম প্রগতিশীল ইতিহাসকার রামশরণ শর্মা


প্রাচীন ভারত ইতিহাসচর্চার প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ত্ব রামশরণ শর্মা [জন্ম – ২৬ নভেম্বর, ১৯১৯, মৃত্যু - ২০ অগষ্ট, ২০১১] চলে গেলেন ৯২ বছর বয়েসে। শিক্ষক ও ইতিহাসকার হিসেবে তাঁর অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষ্য রয়েছে তাঁর লেখা শতাধিক গ্রন্থে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ইতিহাস এর অধ্যপনার পাশাপাশি তিনি পড়িয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো প্রতিষ্ঠানে। ভারতীয় ইতিহাস রিসার্চ কাউন্সিলের তিনি ছিলেন প্রতিষ্টাতা চেয়ারম্যান। মার্কসীয় বীক্ষায় প্রাণিত হয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুসন্ধান ও রচনার যে ধারা ডি ডি কোসাম্বীর মত ঐতিহাসিক ‘ভারতীয় ইতিহাসচর্চার ভূমিকা’র মতো বইতে তৈরি করে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার এর মতো রামশরণ শর্মার মত ইতিহাসবিদরা তাকেই আরো প্রসারিত করেছেন।

রামশরণ শর্মার লেখা বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল

  • প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রতিষ্ঠান
  • প্রাচীন ভারতে শূদ্র
  • ভারতের প্রাচীন ইতিহাস
  • আর্যদের সন্ধানে
  • ভারতের সামন্ততন্ত্র
  • আদি মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ
  • প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
  • ভারতে নগর অবক্ষয়

অন্তজ মানুষকে ইতিহাস অনুসন্ধানের কেন্দ্রে স্থাপন করে তাঁর লেখা ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’(১৯৫৮) ইতিহাসচর্চায় একটি নতুন যুগের সূচনা করে। অন্যদিকে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজ বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখালিখি ভারত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এর উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসকেও তিনি সামনে এনেছেন। তাঁর যে মতটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে সেটি হল ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও তার চরিত্র। ভারতে সামন্ততন্ত্রের সূচনা ড. শর্মার মতে মৌর্যত্তরকালে বিশেষত গুপ্তযুগে। তিনি সামন্ততন্ত্রের লক্ষণ বিচার করেছেন তিনটি আমল ধরে। বাংলা বিহারের পাল বংশ, গুর্জর-প্রতিহার এবং গুজরাটের রাষ্ট্রকূট শাখা। এই প্রসঙ্গে উঠেছে মোগল পূর্ব ভারতে জমিতে ব্যক্তিগত অধিকারের প্রসঙ্গ। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক সামন্ততন্ত্র ও তার অর্থব্যবস্থার উত্থান বিকাশ চরিত্র নিয়েও তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে আর্য সংক্রান্ত বিবাদের সময় বিশেষ যুক্তি ও তথ্য সহযোগে তিনি হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকদের মতগুলি খণ্ডন করছেন। তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন ভারতবর্ষই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। এর পেছনে ছিল বৈদিক ধর্মকে হিন্দু ধর্মের পূর্বসূরী ধরে নিয়ে তার মাহাত্ম্যপ্রচার ও সেই প্রচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। এই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে ‘লুকিং ফর দ্য এরিয়ানস’ (১৯৯৫) এবং তারপর ‘আর্যদের ভারতে আগমন’ (২০০১) বইতে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণের সাহায্যে সঠিক ইতিহাসকে সামনে এনেছেন। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করতে অযোধ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্যকে সামনে এনেছিলেন। বিষ্ণুস্মৃতি উদ্ধার করে তিনি দেখান সেখানে ৫২টি তীর্থস্থানের তালিকা থাকলেও তাতে অযোধ্যার কোনও উল্লেখ নেই। ১৫৭৪ এ তুলসীদাস তাঁর রামচরিতমানস এও অযোধ্যাকে তীর্থস্থান হিসেবে দেখান নি। ধর্মস্থান হিসেবে অযোধ্যার উত্থান অনেক পরবর্তীকালের ঘটনা। ভারত ইতিহাসচর্চায় তাঁর এক বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে ইরফান হাবিব সঠিকভাবেই বলেছেন, “ ড্যানিয়েল থর্ণার এবং ডি ডি কোশাম্বীর পাশাপাশি রামশরণ শর্মাই প্রথম ঐতিহাসিক হিসেবে কৃষককে ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বে অধিষ্ঠিত করেছেন।” সাম্প্রদায়িকতা, সামন্ততান্ত্রিকতা, বর্ণব্যবস্থা জর্জরিত ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের কালো দিকগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর তথ্যমূলক ও আলোকসম্পাতি ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক কর্মীদের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে।