Thursday, September 27, 2018

প্রীতম বসুর চৌথুপীর চর্যাপদ : ফেলা আসা অতীতের জ্ঞানবিজ্ঞান জগতের গল্পকথা


চৌথুপীর চর্যাপদ প্রীতম বসুর দ্বিতীয় আখ্যান, যেখানে তিনি পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল এর পরে আরেকবার বাঙালি জীবনের এক উতরোল সময়ক্ষণের পুনঃনির্মাণে প্রয়াসী হলেন। পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের মতো এই আখ্যানেও প্রাচীন সাহিত্যকীর্তি ও পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী আবিস্কারের সূত্রে একটি থ্রিলারের জন্ম দেন কথক। এখানেও পঞ্চাননমঙ্গলের মতোই দুটি ভিন্ন সময়ের আখ্যান দ্বিবেণীবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলে। পঞ্চাননমঙ্গলে যদি থেকে থাকে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষাভঙ্গীতে লেখা কাব্য অংশ তো এখানে রয়েছে আরো প্রাচীন চর্যাপদের আদলের পদাবলী পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির বাইরের আদলটিই যেমন শুধু কাব্যের আর ভেতরে রয়েছে গণিতের নানা সূত্র, তেমনি এখানেও পদাবলিগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞান,নানা ওষধি ও ভেষজ শাস্ত্রের আকর। চৌথুপীর চর্যাপদ লেখকের পরবর্তী উপন্যাস হলেও এর সময়কাল পঞ্চাননমঙ্গলের চেয়ে অন্তত দুশো বছরের পুরনো। পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির সময়কাল পঞ্চদশ শতকের প্রথম ভাগ আর চৌথুপীর চর্যাপদের ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়া, যখন বাংলায় তুর্কি আক্রমণ সদ্য শুরু হয়েছে। বস্তুতপক্ষে তুর্কি আক্রমণে বিধ্বস্ত বাংলার ছবিটা দুটি আখ্যানেই আমরা পাই, পাই সেই বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের হাত থেকে নিজের অতীত ইতিহাস জ্ঞান বিজ্ঞানকে রক্ষার মরীয়া চেষ্টা।
প্রীতম বসুর দুটি আখ্যানই ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনে যথেষ্ট গবেষণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। আবার এই গবেষণাই কোথাও কোথাও লেখককে প্রলুব্ধও করেছে আখ্যানের গতিকে থামিয়ে তথ্য পরিবেশনে। বিশেষ করে চৌথুপীর চর্যাপদের সাম্প্রতিক সময়ের আখ্যান অংশটির চরিত্র পাত্ররা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চরম সঙ্কটজনক কিছু মুহূর্তেও যেভাবে অতীতের তথ্য উদগীরণ করতে থাকে, তার আখ্যানগত বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠেছে এই দুটি আখ্যানেই ইসলামোফোবিয়ার উপাদান আছে কীনা তা নিয়ে। আমরা পরে এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হব। তার আগে বলা দরকার চৌথুপীর চর্যাপদের বিশিষ্টতার জায়গাগুলি নিয়ে।
এই আখ্যানের সমকাললগ্ন যোজনগন্ধা কেন্দ্রিক আখ্যানটি মাঝে মাঝেই গতি হারিয়েছে, পট পরিবেশের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তিও আমরা পেয়েছি মামাজীর কাছে পাত্রপাত্রীদের বন্দীদশার দীর্ঘ পর্বটিতে। এই দুর্বলতার উল্টোদিকেই রয়েছে গন্ধকালী কেন্দ্রিক প্রাচীন আখ্যানটি, যেখানে প্রীতম বৌদ্ধ পরিবেশের অসামান্য পুনঃনির্মাণ ঘটান। শুধু যে প্রাচীন অংশটির আখ্যানবিন্যাস এখানে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তাই নয়, যুগের আবহটি ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও লেখক বিশেষ সাফল্য পেয়েছেন। আর অতি অবশ্যই বলতে হয় গন্ধকালী চরিত্রনির্মাণ প্রসঙ্গে। এক গ্রাম্য বালিকা, যার এমনকী পাঠশালায় যাবার অনুমতি পর্যন্ত মেলে নি এক সময়, সে কী করে সমকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বিদুষী হয়ে উঠল, হয়ে উঠল ভেষজ বিষয়েও পারঙ্গম, তার নাটকীয় আখ্যান এখানে আছে। কিন্তু গন্ধকালীর বিদুষী থেরী সঞ্জীবনীতে রূপান্তরণের মধ্যে দিয়েই তার জীবনবৃত্ত শেষ হয়ে যায় নি। তিব্বতী রাজকুমার খু স্তোন এর সাহচর্যে তার চাপা থাকা নারীত্বের দিকগুলি অগ্নিস্ফুলঙ্গের মতো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। থেরীর জীবন থেকে সে আবার সরে আসে গন্ধকালীর সাংসারিক নাম পরিচয়ে।
সমকাললগ্ন আখ্যানটির কেন্দ্রীয় চরিত্র যোজনগন্ধা পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, ‘সিদ্ধমাতৃকা : সিক্রেট কোডস অব ট্যানট্রিকস’ নামের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক বিখ্যাত এক বইয়ের লেখিকাতাঁর বাবা ডক্টর বুধাদিত্য চ্যাটার্জিও ছিলেন পুরাতত্ত্বের পণ্ডিত ও আবিষ্কারকপুরাতাত্ত্বিক আবিস্কারের নেশাতেই একসময় তাঁর প্রাণ যায়। যেখানে তিনি মারা গিয়েছিলেন সেই চৌথুপী আরেকবার উঠে আসে খবরে। একটি মূর্তি উদ্ধার ও খুনের সূত্রে। যোজনগন্ধা ক্যান্সার আক্রান্ত, তার অপারেশনের দিন নির্ধারিত হয়ে আছে। তবু এই বিশেষ জায়গাটির আকর্ষণে সে দুদিনের জন্য প্লেনে করে পাড়ি দেয় উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে। ঘটনাচক্রে এই দুদিন বেড়ে যায় দু সপ্তাহেযোজনগন্ধা ও অন্যান্যরা মামাজী নামের এক ব্ল্যাকমেলারের হাতে বন্দী হয়। এই ঘটনাবহুল সফরকালেই হঠাৎ পাওয়া গন্ধকালীর লেখা এক চর্যাপদের পুঁথি হাতে আসে যোজনগন্ধার। সে এর পাঠে নিবিষ্ট হয়। ঘটনার নানা আবর্তে তার সহপাঠক হিসেবে আসেন তিব্বতী এক লামা, লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল, যিনি ভেষজ বিদ্যায় ও সিদ্ধম লিপি তথা বৌদ্ধ শাস্ত্রে পারঙ্গম। উভয়ে মিলে গন্ধকালীর ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় লেখা বৌদ্ধ গান ও দোহা’গুলি আজকের ভাষায় পড়ে ফেলেন। বস্তুত গন্ধকালী কাহিনিটিই এই উপন্যাসের মূল মর্মবস্তু।
গন্ধকালী ছিলেন উত্তর বাংলার এক গ্রাম্য ধীবরের কন্যা। বাল্যে তাকে ডাকাতেরা অপহরণ করেছিল, তাই সংসারের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে সমাজ তাকে দূরে রেখেছিল। সেই সময়কালটা ছিল বাংলায় তুর্কি আক্রমণের প্রথম পর্ব। ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাহিনী তখন একের পর এক মন্দির, বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করছে, সেখানকার পুঁথিপত্র জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্মমভাবে হত্যা করছে সেখানকার মানুষকে, তাদের ওপর জোরজুলুম করে চাপিয়ে দিচ্ছে নিজেদের ধর্ম। এই সময়েই গন্ধকালী নদীর বুক থেকে উদ্ধার করেন বৌদ্ধ আচার্য শ্রীধর পণ্ডিতকে। জ্যোতিষ শাস্ত্রের দিকপাল পণ্ডিত আচার্য শ্রীধর ছিলেন নালন্দা, বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রাক্তন অধ্যাপক, শিলাদিত্য সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষ।  শিলাদিত্য সঙ্ঘারাম তুর্কি আক্রমণে ধ্বংসের সময় সেখান থেকে কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন। মৃতপ্রায় শ্রীধর আচার্যকে সুস্থ করে তোলেন গন্ধকালী ও তার বাবা চন্দর মাঝিসেখানেই ছেলেদের পড়ানোর কাজে যুক্ত হন শ্রীধর। এমন পণ্ডিতকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে গ্রামবাসীরাও খুশি হয়। কিন্তু বিবাদ বাঁধে গন্ধকালী বিদ্যাশিক্ষায় যুক্ত হলে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে শ্রীধর পণ্ডিতের শাস্ত্রের নিদান ভিত্তিক যুক্তিমালাও সমাজের কিছু মুরুব্বীকে আশ্বস্ত করে নি। লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, সিকতা, নিভাবরি, ঘোষা, মৈত্রেয়ী, গার্গি প্রমুখ প্রায় কুড়িজন বিদুষী মহিলার রচিত স্তোত্র যে ঋকবেদে আছে – এই তথ্যকেও তারা আমল দিতে প্রস্তুত হয় নি। পরিবেশ পরিস্থিতির জটিলতা শেষপর্যন্ত গন্ধকালীকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে। কিন্তু তার মধ্যেই শ্রীধর পণ্ডিতের শিক্ষা এবং নিজের ধীশক্তির সমন্বয় তাকে একজন পারঙ্গম জ্যোতির্বিদ করে তুলেছে অতি অল্প বয়সেই। ঘটনার বিচিত্র আবর্ত পেরিয়ে শেষমেষ গন্ধকালী নানা বাধা অতিক্রম করে এসে হাজির হয় চৌথুপী বিহারে, যা ছোট হলেও জ্ঞানচর্চার এক প্রশংসনীয় কেন্দ্র ছিল। বিশেষ করে এর জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগটি ছিল ফলিত ও তাত্ত্বিক চর্চার এক উন্নত প্রতিষ্ঠান। সে যুগের দুই শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ শান্তভদ্র ও তিব্বতী আচার্য তোন পা ছিলেন এর দুই স্তম্ভ। আর শীর্ষে ছিলেন সদ্য তরুণী গন্ধকালী, যিনি ততদিনে রূপান্তরিত হয়েছেন থেরী সঞ্জীবনীতে।
অতীতের এই মূল কাহিনীটির সঙ্গে এসে মিশেছে একটি ছোট তিব্বতী উপকাহিনীও। যেখানে আমরা দেখি তিব্বতের রাজা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। তিব্বতে এর চিকিৎসা নেই, কিন্তু ভারতে আছে। কুষ্ঠের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছে রাজপুত্র খু স্তোনেরও। হাজার হাজার তিব্বতবাসীও এতে আক্রান্ত। নিজের, পরিবারের ও দেশের রোগ মুক্তির উপায় খুঁজতে বিঘ্নসঙ্কুল পথ পেরিয়ে খু স্তোন হাজির হন ভারতে। পথে তার সমস্ত সঙ্গীরাই মারা যান শত্রু আক্রমণে। ভারতে আসার পথে খবর পান তার কাকা তার বাবাকে বন্দী করে নিজেই সিংহাসন দখল করেছেন। ভারতে এসে খু স্তোন শেষমেষ এসে পৌঁছন চৌথুপী বিহারে, সেখানেই তার সাথে সাক্ষাৎ হয় থেরী সঞ্জীবনীর।
চৌথুপীও তখন মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। যে কোনও মুহূর্তে তুর্কীরা এসে ধ্বংস করতে পারে বিহার ও তার পুঁথিশালা যেখানে রয়েছে পদ্মসম্ভব, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, প্রজ্ঞাকরমিতি, পণ্ডিত নারো পা, স্থবির বোধিভদ্র, শ্রীজ্ঞান মিত্রের মতো পন্ডিতদের লেখা বহু মহামূল্যবান পুঁথি আশেপাশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিহারগুলি থেকেও - যার অন্যতম বিক্রমশীল মহাবিহার - বেশ কয়েক হাজার পুঁথি তখন গোপনে এসে পৌঁছেছে চৌথুপীতে বাংলা তথা ভারতের জ্ঞানসাধনার সেই অমূল্য সম্পদগুলিকেও তুর্কী ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচানো নিয়ে সবাই চিন্তিত বেশ কিছু পুঁথি চৌথুপীর তিব্বতী পণ্ডিত তোন পার সহায়তায় তিব্বতে পাঠানো হয়েছে। বাকী আরো কয়েক হাজার পুঁথিকে এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় যাত্রার মধ্যে দিয়ে শত্রুর শ্যেন দৃষ্টি ও মাথার ওপর উদ্যত মৃত্যুর করাল ছায়া অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত তিব্বতে নিয়ে যান খু স্তোন ও থেরী সঞ্জীবনী। অবশ্য এই যাত্রায় থেরী সঞ্জীবনীর চীবর ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন পূর্ণ যৌবনা নারী গন্ধকালী। যুবরাজ খু স্তোনের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে এই দুর্গম নাটকীয় অভিযাত্রার সময়। তিব্বতে গিয়ে কাকার হাত থেকে সিংহাসন মুক্ত করেছেন স্তোন পা, পিতার মৃত্যুর পর রাজা হয়েছেন। আর রণ কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার মিশেলে পরাজিত করেছেন আক্রমণকারী পরাক্রান্ত তুর্কি বাহিনীকে।
যেহেতু এই উপন্যাসে তুর্কী আক্রমণের ভয়াবহতা, তাদের বিধর্মীদের আক্রমণ, মঠ মন্দির ধ্বংস ও পুঁথি পোড়ানো ও হত্যালীলার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে,রয়েছে সে সম্পর্কে এই স্বাভাবিক বীতরাগের আবহও – তাই কেউ কেউ এই আখ্যান প্রসঙ্গে তুলেছেন ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ। বিশেষ করে এমন এক সময়ে এই আখ্যানটি পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে যখন ইসলামোফোবিয়া দেশ দুনিয়া জুড়ে যথেষ্ট ব্যাপ্ত ও চর্চিত একটা বিষয়।
এই প্রসঙ্গে এটাই বলার যে এই সময়ের ইতিহাসকে আজকের সমাজ রাজনীতিতে টেনে যদি একটি ধর্মর মানুষজনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করার চেষ্টা করা হয় সমাজ বাস্তবতার দৈনন্দিনতায়, ইতিহাসের প্রতিশোধ নেবার ভাষ্যটি উদগ্র হয়ে ওঠে, যেমনটা কখনো কখনো হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় তাকে ইসলামোফোবিক বলে আখ্যাত করা সঙ্গত। কিন্তু প্রীতম বসু তুর্কী আক্রমণের সময়ের বাস্তবতার কোনও প্রতিস্পর্ধাকে সমকালে হাজির করার বয়ান হাজির করেন না, তার ইঙ্গিৎ মাত্রও দেন না। প্রীতম তুর্কী আক্রমণের প্রেক্ষাপটে তার এই আখ্যান নির্মাণ করেছেন এবং সেই সময়ের ইতিহাস স্বীকৃত আবহটিই তিনি নির্মাণ করেছেন মীনহাজ এর তবাকাৎ ই নাসিরি সহ সেই সময়ের স্বীকৃত ইতিহাসের উপাদানগুলি থেকে প্রীতম সরে যান নি এবং সেই নিরিখে তার এই আখ্যানের প্রতি ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ তোলা বাতুলতা
অবশ্য অতীত গৌরব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অর্জনের কথাগুলি বলতে গিয়ে প্রীতম অতিরেক করেছেন, এই অভিযোগ অনেকদূর পর্যন্ত তথ্য সমর্থিত মহাভারতের কাল গ্রহ নক্ষত্রের গ্রহণের বিস্তারিত বিবরণ সূত্রে মেপে ফেলার অধ্যায়টিই হোক বা সে যুগে আলোর গতির পরিমাপ জানা থাকার প্রসঙ্গই হোকপ্রীতম কল্পনাকে বাস্তব তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি দূরে কোথাও কোথাও নিয়ে গিয়েছেন এটি আখ্যানমাত্র,ইতিহাস নয়,তাই আখ্যানকারের এমত কিছু স্বাধীনতা থেকেও যায় একথা যারা বলতে চান - তাদের বলা যেতে পারে এইসব অতিরেক বিপুল গবেষণার ভিত্তিতে আখ্যান নির্মাণের যে বিশিষ্ট অর্জন,তার দিকেই কিছু প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়
কিছু অতিরেক সত্ত্বেও গন্ধকালী আখ্যান নির্মাণ যে উচ্চতায় এখানে পৌঁছল, সমকালীন যোজনগন্ধা আখ্যানটি তার বিপরীতে কেন এত নিষ্প্রাণ ও স্থবির হয়ে রইলো তা পাঠককে ভাবাবেই। এখানে ঘটনা পরম্পরার অতি নাটকীয়তাই শুধু যে বিশ্বাসের বাস্তবতাকে আঘাত করে তাই নয়, সঙ্কট মুহূর্তে চরিত্র পাত্রদের আচার আচরণ ও দীর্ঘ দীর্ঘ বচনগুলিও অবিশ্বাস্য মনে হয়। বিশেষত আখ্যান কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর যখন ব্ল্যাকমেলার মামাজীর অধীনে যোজনগন্ধা ও হাবিলদারের দীর্ঘ বন্দিদশা শুরু হয়, তখন থেকে আখ্যানও তার গতি হারিয়ে একই জায়গায় প্রায়শ পুনরাবৃত্ত ফলত ক্লান্তিকর হতে থাকে। যোজনগন্ধার আচার আচরণ সংগতিপূর্ণ হচ্ছে না এটা অনুভব করেই কি লেখক একদম শেষে ক্যান্সারের পাশাপাশি ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার নামক তার এক মানসিক রোগের কথা পাঠককে জানিয়ে দেন ?
অতিরেকগুলি বাদ দিয়েও প্রীতম যেভাবে বাংলা তথা ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান জগতের বিশিষ্ট অর্জনগুলিকে একের পর এক তুলে আনেন, তার ধারাবাহিক চর্চার কথা বলেন – তা আমাদের জাতিগত গৌরবকে পুনঃনির্মাণের এক জরুরী চেষ্টা। আমাদের গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ব্যুৎপত্তিই হোক বা ভেষজ চিকিৎসাশাস্ত্রের বিষ্ময়কর বিকাশই হোক, অনেক পরিশ্রমসাধ্য গবেষণার মধ্যে দিয়ে প্রীতম তার স্বাদু পরিবেশন করেছেন এখানে। অনেক প্রচলিত ধারণাকে উলটে পালটে দিয়েছেন। অনেক নতুন তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে আমাদের অতীতের প্রতি বিষ্ময়মুগ্ধ ভালোবাসার বোধ জাগিয়ে তুলেছেন, যা চৌথপীর চর্যাপদের অন্যতম অবদান।
ভারতীয় ভেষজের আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে এবং তার সন্ধানে বে আইনি কারবারের চেষ্টা আমরা সংবাদপত্রের পাতায় মাঝেমাঝেই দেখতে পাই। প্রীতম আমাদের জানিয়েছেন কিড়াজড়ি নামে লোকমুখে জনপ্রিয় এক ঘাসের কথা, যার রয়েছে যৌবন প্রদীপ্ত করার অনবদ্য শক্তি। জানিয়েছেন ডাকিনী ব্রহ্মকালির বইয়ের সূত্রে এ সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘকালীন চেনাজানার কথা। ডাকিনী শব্দের বর্তমান লোক প্রচলিত অর্থের সাথে প্রকৃত অর্থের পার্থক্যটি ধরিয়ে দিয়ে প্রীতম জানিয়েছেন বিদ্যার সঙ্গে শব্দটির সংযোগের কথা, ডাক ও খনার বচন কথাটির মধ্যে যা ধরা আছে। গন্ধকালীর শিক্ষাসূত্রে এখানে এসেছে ভারতের জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার মহান ঐতিহ্যের কথা। আর্যভটের আর্যভটীয়, ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত ছাড়াও এসেছে পরাশর সিদ্ধান্ত, অত্রি সিদ্ধান্ত, গর্গ সিদ্ধান্ত, সূর্য সিদ্ধান্ত, মরীচি সিদ্ধান্ত, অঙ্গিরস সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বইগুলির কথা। এসেছে ফলিত জ্যোতিবির্জ্ঞান চর্চায় সেকালের মানমন্দিরে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রের প্রসঙ্গ, যার মধ্যে ছিল জলঘড়ি, শঙ্কু, ফলক যন্ত্র, কপাল যন্ত্র, দোলন যন্ত্র ইত্যাদি।
বিষ এবং ওষধি সম্পর্কে ভারতীয় ভেষজবিদ ও চিকিৎসকদের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডারের কিছু কিছু নিদর্শন গন্ধকালীর বইয়ের সূত্রে এখানে হাজির করেছেন আখ্যানকার। সেই হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান পুনরুদ্ধারে বিশ্বের তাবড় তাবড় ওষুধ কোম্পানির আগ্রহ ও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের কথাও জানিয়েছেন। চাণক্য বর্ণিত মারাত্মক বিষ বা ক্ষুদাহরণকারী ওষুধের কথা এখানে এসেছে। লামা লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল জানিয়েছে মৌর্যযুগের সেনাদের একপ্রকার ক্ষুধাদমনকারী ওষুধ দেওয়া হত, যা খেয়ে পনেরোদিন বা এক মাস সেনারা খাদ্যাভাবেও যুদ্ধ করতে পারত। নারীদের ঋতুবন্ধ করার ওষুধও সেকালে জানা ছিল বলে লামার মুখ থেকে শুনি আমরা, শুনি চাণক্য বর্ণিত সেযুগের একধরনের কেমিক্যাল ওয়েপেনের কথা
আমাদের অতীতের জ্ঞানবিজ্ঞানের দিকে নজর ফেরানো, নিজের ইতিহাস ঐতিহ্য শিকড়কে শ্রদ্ধা করতে ভালোবাসতে শেখা প্রীতম বসুর প্রথম উপন্যাস পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্য চৌথুপীর চর্যাপদেও বর্তমান। এই ধারায় বাংলায় সাম্প্রতিক কালে আরো উল্লেখযোগ্য লেখালেখি শুরু হয়েছে, তা পাঠকদের কাছে বিপুল সমাদরও পাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের একটি ইতিবাচক দিক।

প্রীতম বসুর পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল


সাহিত্যের পাঠক কম বেশি সকলেই কিন্তু তার মধ্যেই কেউ কেউ জহুরী তাঁরাও পড়েন সাহিত্য, কিন্তু কেবল গল্পের টান বা ছন্দের তানের আকর্ষণে নয় তাদের নজর চলে যায় সৃজনের অন্দরমহলের দিকে। পুঁথির পাতায়, অক্ষর বিন্যাসে প্রাচীন বা মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রামাণিকতা নিয়ে আলাপ আলোচনায় এগুলি অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠে সে আমরা জানি আর এও জানি সাহিত্যের জহুরীদের এইসব পণ্ডিতি আলোচনা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম পেরিয়ে খুব কমই সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ে। কিন্তু কখনো কখনো একটা ব্যতিক্রম তৈরি হয়ে যায়। প্রীতম বসুর মতো প্রবাসী বাঙালি যখন ডুবুরীর মতো ভাষা সাহিত্যের সেই পণ্ডিতি গবেষণার উপাদানকে ব্যবহার করে রোমহর্ষক এক থ্রিলার তৈরি করে দিতে পারেন পাঁচমুড়ার পঞ্চাননমঙ্গলের মতো উপন্যাসে।
আকর্ষনীয় কাহিনী বিন্যাস নিঃসন্দেহে পঞ্চাননমঙ্গল এর আবিস্কার ঘিরে এখানে দানা বেঁধে উঠেছে, কিন্তু সেটাই এই বইয়ের প্রধানতম আকর্ষণ নয়। আমাদের হারানো অতীতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, যা ইউরোপের চোখে জগৎ দেখার বাইরের এক নিজস্বতাকে খুলে দিতে চায়, তাকে আমরা এই আখ্যানে পেয়ে যাই। কীভাবে লেখা হত পুঁথি, কেন কাগজ ব্যবহারে আমাদের এখানে অনেক লিপিকরের দীর্ঘদিনের আপত্তি ছিল, তুলোট পাতা আর তালপাতার পুঁথির পার্থক্য কোথায়, কাহিনীর অন্তর্গত উপাদান হিসেবেই প্রীতম আমাদের তা জানিয়ে দেন। তুলে আনেন বাংলা বর্ণমালার বিবর্তন সূত্রটি। এই আখ্যানের অন্যতম প্রধান দুটি চরিত্রই সারা জীবন ধরে পুরনো সাহিত্য নিয়ে দুভাবে কাজ করেন – সদানন্দ ভট্টাচার্য ও হরু ঠাকুর। প্রথমজনের যদি পারিবারিক ব্যবসা ও নেশা আগ্রহের সূত্রে জহুরীর চোখ তৈরি হয়ে থাকে তো দ্বিতীয় জনের রয়েছে পুঁথি নকলের ও পুঁথি দেখার প্রাতিষ্ঠানিক তালিম। সেইসঙ্গে স্বাভাবিক কবিত্ব যা সহজেই ধরে নিতে পারে পুরনো সাহিত্যের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গীটিকে।
বস্তুতপক্ষে হরু ঠাকুরের আড়াল থেকে লেখক প্রীতম বসু নিজেই এখানে একটি পরীক্ষায় নেমেছেন। চর্যাপদের ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাঝের সময়ের বাংলা ভাষাটি, যার কোনও প্রামাণ্য উপাদান আমাদের হাতে এসে পৌছয় নি অন্ধকার যুগের আড়াল ভেদ করে, সেই ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বাংলাভাষার রূপটি কেমন ছিল। গদ্য আখ্যানের পরতে পরতে মধ্যযুগের পুননির্মিত সেই ভাষায় দীর্ঘ দীর্ঘ পদ্য অংশ মিশিয়ে দেন প্রীতম, বিশেষত কাহিনীর মধ্যভাগ থেকে। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি দক্ষ আখ্যানকার প্রীতমের মধ্যেই কীভাবে মিশে আছে এক ভাষা গবেষক, ছন্দ বিশ্লেষক নিপুণ কবি।
কুসুম কোঁঅলী তার        ছিন্ডিআঁছে অলঙ্কার
ছিন্ডিআঁছে যত মানভএ।
গোরা তার দেহকান্ত        আনুপাম বীর শান্ত
দীঠি কৈল তারি মন জয়।
ছিন্ন নিচোল ছিন্ন কেশ        দেয়ি আপনা বেশ
ঢাকিলেঁ তিরির লাজ
পুরুষের বসনে        জেন বনদেবী বনে
অপরুব তার দেহসাজ।।
বস্তুতপক্ষে ছিরিছাঁদ এর লেখক প্রীতম বাংলা ও সংস্কৃত ছন্দ নিয়ে কতখানি দক্ষ তার প্রমাণ এই আখ্যানের কয়েকটি চকিত মুহূর্তেও আছে। চর্যাপদের চৌপদীর থেকে বাংলা পয়ারের আদি পর্বের নির্মাণটিই শুধু নয়, সংস্কৃত কয়েকটি ছন্দের নিপুণ বিশ্লেষণ তিনি এখানে তুলে আনেন। এখানে আছে তোটক, তূণক, ভুজঙ্গপ্রয়াত প্রভৃতি ছন্দের দৃষ্টান্ত ও আলোচনা।  প্রীতম একটি প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু উত্তর দেন নি। সংস্কৃতে অন্তমিল নেই, বাঙালি তা পেল কোথা থেকে ? হয়ত মুণ্ডা ভাষার আলোচনা ও বাংলার ওপর তার প্রভাব থেকে এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে এগনো যায়। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ
পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের কাহিনীটি আকর্ষনীয়। গুডরিডস থেকে তা হয়ত অনেকেই পড়ে নিয়েছেন।
সদানন্দ ভট্টাচার্য পাঁচমুড়ো গ্রামের সঙ্গতিহীন জমিদার। কিন্তু বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং পুঁথিপাটা নিয়ে ভদ্রলোকের বেশ নাড়াঘাঁটা আছে। বিদেশ থেকে এক ভদ্রলোক আসেন ওঁর কাছে,যাঁর নাম মিঃ ধাড়া। এঁর নাকি লন্ডনে একটা মিউজিয়াম আছে, সেখানে তিনি বাংলা সাহিত্যের পুরোনো সব পুঁথি সংগ্রহ করে রাখেন। এই পুঁথির কাজেই তাঁর এদেশে আগমন এবং সদানন্দ ভটচায্ এর কাছে নাড়া বাঁধা। কালাচাঁদ নামে এক পুঁথি চোর ধাড়াকে চন্ডীদাসের এক নকল পুঁথি বিক্রী করতে এসে সদানন্দের হাতে ধরা পড়ে। সদানন্দ যখন পুঁথির নকলনবীশীর ব্যাপারে জ্ঞান দিতে ব্যস্ত, সেইসময় খবর পাওয়া যায়, পাঁচমুড়ো গ্রামের প্রায় মজে যাওয়া পুকুর চয়নবিলের নীচে থেকে নাকি কিছু পাথর পাওয়া গেছে, যাতে পুরোনো কিসব অক্ষর খোদাই করা আছে। পাথরের ওপর খোদাই করা লেখা পাঠ করে সদানন্দ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর বাংলা ভাষায় এক অনন্য রচনার অংশবিশেষ। এই পঞ্চাননমঙ্গলের অস্তিত্ব নাকি অনেকটা নেক্রোনমিকনের মত। আরব মুসলমানদের কাছে এই বই নাকি,‘শয়তানের পুঁথি’? মানে পঞ্চানন মঙ্গল? কিন্তু সেরকম তো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় না বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে! দেখা যায় এই কাব্য মোটেই অন্যান্য মঙ্গল কাব্যের মত গূঢ় জীবনদর্শন বা দেবস্তুতি নয়। এর ছন্দের মধ্যে লুকানো আছে অঙ্ক। গল্প এগিয়েছে এদিক ওদিক করে। কখনো ইতিহাস, কখনো বর্তমানকে ঘিরে। জালালুদ্দিনের সময়ের পঞ্চমুন্ডি গ্রামের ইতিহাসের ওপর ভর করে চলেছে পঞ্চানন মঙ্গল। তাতে যেমন এক বিয়োগান্তক মঙ্গলকাব্য আছে, তেমনি আছে এক অসম্ভব প্রতিভাবান বাঙালী কবিরাজের রচনায় গনিতের সাথে কাব্যের মেলবন্ধন। পড়লে চমৎকৃত হতে হয়। লুপ্ত এক মঙ্গলকাব্য ঘিরে এক অসাধারণ থ্রিলার”
পঞ্চাননমঙ্গল এর কাহিনীর অন্যতম আকর্ষণের দিক প্রাচীন ভারতের গণিত চর্চার মণিমুক্তোগুলিকে তুলে আনতে পারা। যে কৃতিত্ত্ব আমাদের বিজ্ঞানীদের পাওয়া উচিত ছিল, অনেক সময়েই তাঁরা তা পান নি। আর্যভট্ট বা ব্রহ্মগুপ্তদের আবিস্কারগুলি আরবীয় অনুবাদের হাত ধরে পশ্চিমী জগতে পৌঁছেছে। কিন্তু সে ইতিহাসের অনেকটাই আড়ালে ঢাকা। প্রীতম বসু আমাদের সেই ইতিহাস এখানে আখ্যানের ফাঁকে ফাঁকে জানিয়ে দিতে চান। আটশো শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় পণ্ডিতের হাত ধরে ভারতের সুপ্রাচীন গণিতবিদ্যা পৌঁছোয় বাগদাদের রাজসভায়,আরবিতে অনুবাদ করা হয় সেই পুঁথিগুলির। সেই সূত্রেই পরবর্তীকালে অল-খোয়ারিজমি ‘ভারতের সংখ্যা দিয়ে গণনাপদ্ধতি’ ব্যবহার করে অ্যালগরিদমএর জনক হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে পরিচিত হন (অল-খোয়ারিজম এর অপভ্রংশই আজকের অ্যালগরিদম) আর তারপর নানা আফগানী তুর্কি আরবী শাসক, যাদের অন্যতম বক্তিয়ার খিলজি - ভারতের গর্ব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তিন মাস ধরে পোড়ান হয় ভারতের মহামূল্যবান পুঁথিসমূহকে, যাতে কিনা ভারতের একান্ত নিজস্ব গণিতবিদ্যা আবিষ্কারের উজ্জ্বল ইতিহাস কালের গর্ভে চিরকালের মতো নিমজ্জিত হয়। আমরা জানতে পারি না অনেক আগেই ভারতে জানা হয়ে গিয়েছিল আলোর গতিবেগের পরিমাপ, 'পাই'-এর মান, অ্যালজেব্রা, ত্রিকোণমিতি, দশমিকের ব্যবহার, তথাকথিত ‘পিথাগোরাসের থিওরেম’ পিথাগোরাসের জন্মের দুশো বছর আগেই।
এই গণিত চর্চার ইতিহাস যেমন আমরা জানি না, ঠিক তেমনি আজকের বাঙালি সেভাবে জানেন ই না আমাদের এই বাংলা নৌ নির্মাণ থেকে কামানের ব্যবহারে কত দক্ষ ছিল। চিনের নৌ নির্মাতারা যেমন আসতেন এই দেশে, তেমনি এদেশের যুদ্ধে প্রথম কামান ব্যবহারের গৌরব যিনি পেয়ে থাকেন সেই বাবর স্বয়ং কীভাবে তাঁর আত্মজীবনীতে বাঙালির কামান চালানোর দক্ষতার প্রশংসা করে গেছেন।
এই লেখা শুধু আমাদের অতীতের জন্য গর্বকেই জাগিয়ে তুলতে চায় না। সেই অতীত কীভাবে আরবীয় তুর্কী মুসলমান শক্তির হাতে ধ্বংস হল সেই মনস্তাপও তৈরি করে। এই জন্যেই এই লেখা নিয়ে সতর্ক হবার অবকাশ আছে। যাতে ইতিহাসের বদলার রাজনীতি, যা আমরা রাম মন্দির আন্দোলনে বাবরি ভাঙার ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি, তা এ থেকে জন্ম নিতে না পারে। সম্ভবত লেখকও এই বিপদটি সম্বন্ধে সতর্ক। তাই আমরা দেখি পঞ্চানন এর মন্দিরটি একদিনের মধ্যে অনেক সহকারী জুটিয়ে তৈরি করে দেন যে কুশলী কারিগর, তিনিও এক মুসলমান। এবং তার পূর্বপুরুষদের মন্দির ভাঙার প্রায়শ্চিত্ত যেন তিনি এই কাজের মধ্যে দিয়ে করে যান। পারিশ্রমিক গ্রহণ করেও তা ফিরিয়ে দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের নজির রাখেন।
বাঙালির অতীত মনন চর্চার ইতিহাস এখানে আছে, আছে বিদেশী শক্তির হাতে পর্যদুস্ত হয়ে সেই ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলার মনস্তাপও। আর রয়েছে নিজের শিকড়ে ফেরার টান। মন্দিরের চাতালে কবিগান, ঝুমুর গান, আখড়ার সংস্কৃতি ফিরে পাওয়ার আগ্রহ। বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এমন নান্দনিক উপস্থাপণা বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে কমই হয়েছে।

কন্যাদায়ের আখ্যান : প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিস্কার


যে বাংলার সমাজে মেয়েদের বিয়ে হয় এবং ছেলেরা বিয়ে করে, সেই সমাজের গল্পে উপন্যাসে কন্যাদায় যে বারবার ঘুরে ফিরে আসবে, তা নতুন কোনও কথা নয়। প্রাক ঔপনিবেশিক বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মা বাবার স্বামী সংসারে থাকা কন্যার জন্য নিরন্তর দুশ্চিন্তার আখ্যান আমরা শাক্ত পদাবলীগুলির মধ্যে পেয়েছি। আগমনী বিজয়া পর্যায়ের হিমালয় মেনকা উমা শিবকে নিয়ে লেখা পদগুলি মূলত বাঙালি পারিবারিক চিত্রের আদলকেই ফুটিয়ে তুলেছে। তবে কন্যাদায়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ পিতামাতার ছবিটি উপনিবেশ পর্বের আখ্যানেই বেশি করে ধরা দিয়েছে। মেয়ে দেখতে যাওয়া ও বিয়ের ব্যাপারে খামখেয়ালের নজির বঙ্কিমে তেমন না থাকলেও এই প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু আখ্যানে ঘুরে ফিরে এসেছে। ছোটগল্প রচনার প্রথম পর্বটিতেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন সুপরিচিত “দেনাপাওনা”‘এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায়’ – গল্পের শেষ বাক্যটির অনিঃশেষ লাঞ্ছনা বাঙালি পাঠকের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। নিরুপমা ও তার পিতার অসহয়তার বেদনা বাঙালি সমাজের এক বিশিষ্ট ক্ষতকেই তুলে ধরেছিল। এর পরে তিনি যখন চোখের বালির মধ্যে দিয়ে উপন্যাস সাহিত্যের অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণা শুরু করলেন, তখন বিবাহকে কেন্দ্র করে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতা ও কন্যাপক্ষের করুণ দায়ভাগ বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল। মহেন্দ্র বিনোদিনী ও আশা উভয়কেই বিয়ে করা এবং না করার সিদ্ধান্ত এখানে বেশ খেলাচ্ছলেই নেয় এবং ইচ্ছামত তা পরিবর্তন করে। বিপরীতে বিনোদিনী বা আশার মহেন্দ্রর সাথে বিবাহ হয় বা হয় না এবং সেটা তাদের পরবর্তী জীবনের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। চোখের বালি অবশ্য এই কারণেই বিশিষ্ট এবং শতবর্ষ পেরিয়ে এসেও এখনো আকর্ষণীয়, কারণ এর নায়িকা বিনোদিনী নেহাত বিধবার করুণ জীবন কাটানোর বিধিলিপিকে না মেনে নিজের জীবন তৃষ্ণাকে মেলে ধরে। বিবাহের মধ্যে দিয়ে সংসারে ও জীবন যৌবনে তার প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে রবীন্দ্রনাথ শেষপর্যন্ত স্বীকার করে না নিয়ে তাকে কাশীবাসী করেন ঠিকই, কিন্তু নীতিবাদের কাছে শিল্পের ন্যায়ের এই পরাজয়ের আলোচনাকে বিনোদিনী উন্মুক্ত করে দিয়ে যায়।
বিবাহের নির্বাচন ও প্রত্যাখ্যান পুরুষের দিক থেকেই হবার প্রচলিত সমাজরীতিটি সেভাবে ভাঙার আগেই সাহিত্যের আঙিনায় তাকে অবশ্য প্রশ্ন করতে এবং ভাঙতে উদ্যত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শেষের কবিতায় চয়নের প্রশ্নটি ও বিবাহে নারী পুরুষের সাম্যের জায়গাটি নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। বস্তুত সে আলোচনাই উপন্যাসটির প্রাণধর্ম। তিনসঙ্গীর গল্পগুলিতে, যেমন ল্যাবরেটরি বা রবিবার এ এই নিয়ে আরো নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা আলাপ আলোচনা চালিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ যুগধর্মের নতুন যে প্রশ্নগুলিকে সমাজের প্রচলিত গতির দিক থেকে খানিকটা এগিয়েই সাহিত্যে জায়গা করে দেন, নারীর অধিকারের প্রশ্নে যথেষ্ট দরদী বলে স্বীকৃত শরৎচন্দ্রে তা কিন্তু আমরা সেভাবে পাই না। অরক্ষণীয়ার মত গল্প শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার অন্যতম চাবিকাঠি। অতুলের হাতে নিজ কন্যাকে সমর্পণ করে তার ভবিষ্যতকে সুনিশ্চিত করাই দুর্গামণির জীবনের মূল কামনা। সেই সম্ভাবনা নানা পাকেচক্রে যত অন্তর্হিত হয় আমরা তাকে ততই হতোদ্যম, বেদনাবিধূর ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে দেখি। আবার তার প্রত্যাবর্তনেই কেবল তিনি শান্তিতে চোখ বুজবার রসদ পান।
একদিক থেকে দেখলে শরৎচন্দ্রের অরক্ষণীয়ার সাথে প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিস্কারের বেশ কিছু মূল আছে। কিন্তু এ মিল মূলত বহিরঙ্গের মিল। শরৎচন্দ্র মূলত সামাজিক স্থিতাবস্থাটির আবেগদীপ্ত ভাষ্যকার। অন্যদিকে প্রেমেন্দ্র মিত্র অনুচ্চকিত আখ্যান ভঙ্গীমায় আধুনিক নাগরিক জীবনের স্থিতাবস্থাটিকে বিদ্রুপ করেন। গল্পের অনামা যুবকের প্রতিশ্রুতিদান ও প্রতিশ্রুতিভঙ্গই এই আখ্যানটির অন্তিম ও পরম মোচড়।

নয়া উদারবাদের ছেলেমেয়েরা : স্মরনজিৎ এর পাল্টা হাওয়া


Y2K জমানার কলেজ পড়ুয়া বা সদ্য পাশ করা কসমোপলিটন ছেলেমেয়েদের চালচলন, ভাবনা চিন্তার রকম সকমকে সাম্প্রতিক সময়ের বাংলা উপন্যাসের একটি ধারা বারবার ধরতে চেয়েছে। বাণী বসুর 'একুশে পা' এদের নিয়ে লিখে একসময়ে আলোড়ন তুলেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে গত এক দশকে এই ধারায় লেখালেখি করে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল হয়েছেন স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। ১৯৭৬ এ জন্ম নেওয়া স্মরণজিৎ এর লেখালেখিগুলি ২০০৩ থেকে পত্রিকার পাতায় ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং এক দশকের মধ্যেই তার প্রায় ডজনখানেক উপন্যাস ও গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়েছে। কসমোপলিটন টিন টোয়েন্টি কিশোর কিশোরিদের লক্ষ্যবস্তু করে প্রকাশিত আনন্দবাজার গোষ্ঠীর 'উনিশ কুড়ি' পত্রিকার নিয়মিত লেখক হিসেবে তিনি প্রথম পরিচিতি পান। এই পত্রিকাটি বাজারী সাফল্যে এবং প্রভাবে আবির্ভাবের পরেই যথেষ্ট সাড়া ফেলে। নয়া উদারবাদের সাংস্কৃতিক মুখ হিসেবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি সমালোচনা ও আক্রমণের মুখোমুখিও হতে হয় একে। 
এই ধারার লেখালেখিগুলিকে বিশ্লেষণ করতে আমরা শুরু করতে পারি স্মরণজিৎ এর 'পাল্টা হাওয়া' উপন্যাসটি দিয়ে। এই উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে রীপ ও তার বন্ধুগোষ্ঠীটি, সদ্য কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরনো বয়স পঁচিশের আশেপাশে। এর সঙ্গেই আছে সদ্য কলেজে ঢোকা রীপের ভাই পুলুর আঠারো উনিশের আরেকটি বন্ধুগোষ্ঠী।
রীপ ব্যবসায়িক পরিবারের ছেলে। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর নিজেদের পারিবারিক ব্যবসার শেয়ার কাকাদের কাছে বেচে দিয়ে সে বেছে নেয় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র এর জীবন। আছে তার বন্ধু আয়ান। তার বাবা অধ্যাপক কিন্তু সে পরিচিত পেশাগুলির পরিবর্তে ওয়াইল্ড লাইফ কনসারভেশন এর মতো কাজ বেছে নেয়, কারণ সেখানেই তার প্রাণের আরাম। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শাক্যকে তার বাবা যেভাবে হোক মার্কিন দেশে পড়তে পাঠাতে ব্যগ্র, কারণ এখানে কোনও ফিউচার আছে বলে তিনি বিশ্বাসই করেন না। আর আছে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের পুষ্পল। একটি খুঁড়িয়ে চলা বইয়ের দোকানের টানাটানির আয় থেকে উঁকি দেয় তার অ্যাথলিট হবার স্বপ্ন।
রীপের দুই বান্ধবী তিথি আর মৌনিকা। তিথি রীপের সঙ্গে একই সফটওয়্যার ফার্মে কর্মরত। মৌনিকা বেছেছে পরিবেশ নিয়ে সক্রিয় একটি এন জি ওর চাকরী।
এই আখ্যানে আমরা সফটওয়্যার ফার্ম, এন জি ও কার্যকলাপ, কর্পোরেট ব্যবসার জগৎ আর ছবি আঁকিয়েদের জগতের কয়েক টুকরো ছবিকে বেশ স্পষ্টভাবে পাই। সফটওয়্যার ফার্ম এর ডেটলাইন মেইনটেম করার কড়া চাপ, বিদেশী কোম্পানীর জন্য প্রস্তুত রপ্তানীমুখী ব্যবসার ধরণ ধারণ, কর্মক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও অন্যকে দুমড়ে দেওয়ার হরেক অপকৌশল এর নানা কীর্তিকাহিনী আমরা দেখতে থাকি। অবশ্য অসুস্থ পারস্পরিক সম্পর্কের চেহারাটা চাকরী জগতের চেয়ে তথাকথিত সৃজনশীল জগতে কম কিছু নয়। রাই এর সূত্রে আমরা ছবি আঁকিয়েদের জগৎটির সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হই। ক্রিয়েটিভ জগতের লোকেদের মধ্যে বিশ্রী পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, বিদেশযাত্রা থেকে প্রদর্শনীতে সুযোগ পাওয়া নিয়ে খেয়োখেয়ি বেশ বেআব্রুভাবেই এখানে উঠে আসে।
কর্পোরেট ব্যবসার ধরণ ও এন জি ও কার্যকলাপের পারস্পরিক সম্পর্ক এই আখ্যানের কেন্দ্রে থাকা প্রেম সম্পর্কের টানাপোড়েনগুলির মধ্যে একটা অন্য স্বাদ নিয়ে আসে। এই আখ্যানে ফ্রেশ ওয়াটার বলে একটি এন জি ও কে আমরা পাই যারা একটি কর্পোরেট সংস্থার ঘটানো দূষণ নিয়ে প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বা তাদেরই কোনও কোনও কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কর্পোরেট এর অশুভ আঁতাত বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মানি পাওয়ার থেকে মাসল পাওয়ার – সমস্ত কিছুকেই ব্যবহার করে দূষণের অভিযোগটি আড়াল করতে চায় কর্পোরেট সংস্থাটি। কারণ ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট খাতায় কলমে থাকলেও তা কার্যত বন্ধই থাকে খরচ কমানো বা মুনাফা বাড়ানোর আছিলায়। এর মূল্য দিতে হয় সংশ্লিষ্ট গ্রামের প্রায় হাজার খানেক মানুষকে। এন জি ওর চেষ্টায় খানিকটা মিডিয়া দাক্ষিণ্য প্রথম দিকে পাওয়াও যায়, যদিও চাপের মুখে মিডিয়া পরে কভারেজ দিতে অস্বীকার করে। তবে শেষপর্যন্ত এন জি ও কর্ত্রী মোটা টাকা আর বিদেশ ভ্রমণের লোভে কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে আপোষ করে লড়াই থেকে সরে আসেন। শ্রেণি সংগ্রামের গ্রান্ড ন্যারেটিভ এর ধারণাটির পরিবর্তে নিও লিবারাল জমানায় প্রতিবাদের যে এন জি ও নির্ভর প্রেশার গ্রুপের ধারণাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তার ভেতরের ফাঁকি সমেত এই নয়া 'প্রতিবাদী ইনস্টিটিউশন' এর একদিকের ছবিটা স্মরণজিৎ স্পষ্ট করে দেন।
কিন্তু স্মরণজিৎ এর আখ্যান এই নতুন সময়ের যে ছবিটা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে সেটা হল উনিশ কুড়িদের মনোজগৎ। অবশ্য শুধু উনিশ কুড়িরাই নয়, তাদের মা বাবা কীভাবে ভাবছেন তার ছবিও এখানে পাই। শাক্যের বাবার কাছে ছেলেকে যেন তেন প্রকারেণ বিদেশে পাঠানোটাই যেমন একমাত্র লক্ষ্য, তেমনি মৌনিকার মারও তীব্র আকাঙ্ক্ষা মেয়েকে প্রবাসী ধনী চিকিৎসকের কাছে পাত্রস্থ করার। এক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের নিজেদের ইচ্ছা অনিচ্ছেকে মূল্য দিতে তারা একেবারেই প্রস্তুত নন। এর বিপরীতে অবশ্য আছেন তিথি এবং অহনার বাবা, যিনি মেয়েদের স্বাধিকারকেই আগাগোড়া লালন করে এসেছেন। আবার নবীন প্রজন্মের চিত্রশিল্পী হিসেবে রাই স্কলারশিপ নিয়ে মার্কিন দেশে যাবার সুযোগ পেতে সবকিছু করতে প্রস্তুত, যদিও তার মা চেয়েছিলেন দেশেই থাকুক তার বড় মেয়ে, অসুস্থ বাবার নির্ভরতা হিসেবে।
নবীন প্রজন্মকে কোনও একটি নির্দিষ্ট ছকে ঢেলে সাজাতে চাননি স্মরণজিৎ এবং তাদের আপন আপন মনোজগৎকে আলাদা করে সামনে রাখতে চেয়েছেন। অবশ্য জীবিকাগত ও পরিবারগত স্বাভাবিক ভিন্নতার বাইরে তাদের চিন্তাভাবনার একটি স্বাভাবিক, হয়ত বা বয়সোচিত প্যাটার্ন আমাদের চোখে পড়ে। প্রেম সম্পর্কের বিভিন্ন টানাপোড়েন তাদের প্রায় সবার মানসজগতের প্রধান অংশ। কিন্তু ছেলেদের প্রেমজীবন এখানে খানিকটা বৈচিত্র্যহীন। প্রায় সবাই ফেলে আসা নস্টালজিয়াগুলোকে নিয়ে কাতর বা সম্ভাব্যতা অসম্ভাব্যতার দোলাচলে দ্বিধান্বিত। বিপরীতে মেয়েদের প্রেমজীবন অনেকটাই বৈচিত্র্যময়তা নিয়ে হাজির। তিথি, মৌনিকা, রাই, মুন – সবাই নিজের নিজের কেরিয়ার নিয়ে সচেতন। তিথি প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে নানা মিথ্যা বলে দূরে সরিয়ে দিতে পারে দ্বিধাহীনভাবে। রাই পেইন্টিং কেরিয়ারকে সফল করতে যেমন মানুষকে অক্লেশে ব্যবহার করে নিতে পারে, তেমনি দাম্পত্য বা পরকিয়া সম্পর্কে কোনও সংস্কার রাখে না। মুন পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে নিজের লেসবিয়ান আইডেনটিটি নিয়ে দ্বিধান্বিত তো নয়ই, বরং একেই মুক্তির পথ বলে মনে করে। মৌনিকা নিজের জীবন জীবিকার স্বাধীনতার জন্য পরিবার ও সমৃদ্ধিময় বৈবাহিক জীবনের হাতছানির বিরুদ্ধে লড়াই করে। পুরুষতান্ত্রিক হাবভাব সমৃদ্ধ মার্কিন প্রবাসী ডাক্তার হবু বরকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে।
উল্টোদিকে শাক্যর দিদির মতো মেয়েরাও আছে। যে একমাত্র পাইলট হবু বরের প্রেয়সী পরিচয়টুকু নিয়েই বেঁচে থাকে। তবে এটা সাধারণ ছবি নয়। বস্তুতপক্ষে নয়া উদার অর্থনীতি কাজের জগতে শৃঙ্খলের নতুন নতুন বেড়ি নিয়ে হাজির হলেও তা যে নতুন সময়ের মেয়েদের পুরুষতান্ত্রিক নিগঢ় থেকে মুক্ত করে দিচ্ছে, তার ছবি বারবার ফুটে উঠেছে স্মরণজিৎ এর এই আখ্যানে। বিশেষত আগের প্রজন্মের মায়েদের সংসারে লাঞ্ছিত কুন্ঠিত অবস্থানের বিপ্রতীপে এই জাগৃতি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কিন্তু নতুন সময় মেয়েদের জগৎকে প্রসারিত করলেও মহানগরীর এলিট সোসাইটির সঙ্গে গ্রাম মফস্বলের দূরত্বকে তা কতটা দুস্তর করে তুলেছে, সে সম্পর্কেও আমরা অবহিত হই। একদিকে তিথি মুনেরা যখন আমেরিকান লোকাল টাইম মেনে নাইট শিফটে কাজ করছে, অন্যদিকে গ্রামীণ ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করা মৌনিকার পর্যন্ত মধ্যমগ্রাম থেকে লোকাল ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতাকে বিভীষিকা মনে হয়। আমরা দক্ষিণ কোলকাতাবাসী এই আখ্যানের সমস্ত এলিট পরিবারের টিন এজারদের প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে ব্যক্তিগত যান ব্যবহার করতে দেখি। গণপরিবহনের জায়গায় ব্যক্তিগত যানরতি নয়া উদার আর্থিক নীতিমালারই অন্যতম অভিজ্ঞান।
প্রতিবাদ সম্পর্কে এই প্রজন্ম সাধারণভাবে কী মনে করে ? ষাট সত্তরের 'তোমার নাম আমার না ভিয়েতনাম' বা 'নকশালবাড়ি লাল সেলাম' থেকে কতদূরে আজকের এই প্রজন্মের অবস্থান ?  অবস্থানগত কারণেই প্রতিবাদী বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কথা যাদের, সেই নিম্নবর্গীয়দের প্রতিনিধিত্ব এ আখ্যানে করে যে বাটু সে স্মরণ করে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মেন্টর নাপিত যুগল এর কথা “ প্রতিবাদ হল এ যুগের শ্রেষ্ঠ ঢ্যামনামো। কাজ হয় না, কিন্তু টিভিতে ছবি দেখা যায়।”
বস্তুতপক্ষে সাব অল্টার্ন চরিত্রগুলির রূপায়ণ এর মধ্যে দিয়েও নিও লিবারাল জমানাকে দেখা বোঝার একটা বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে এই আখ্যান। এখানকার সাব-অল্টার্নরা কেউই অর্গানাইজড ওয়ার্কিং ক্লাসের অংশ নয়। তারা - বাটু, যুগল, মুন্না, লাটিম – সকলেই স্বভাবে বা অভাবে শেষপর্যন্ত ডেসপট হয়ে যায়, প্রতিবাদী প্রলেতারিয়েত তাদের থেকে আর জন্ম নিতে পারে না, সামনে আসে তাদের লুম্পেনসিই। প্রতিতুলনায় মনে পড়ার মতো ব্যাপার এই অংশের মানুষেরাই কিন্তু চোক্তার আর ফ্যাতারু হিসেবে সাবভার্ট করতে চায়, সিস্টেম ভাঙতে চায় নবারুণ ভট্টাচার্যের আখ্যানগুলিতে। স্মরনজিৎ এর দেখার চোখ, ভাবার প্যাটার্ন ভিন্ন। এই ভিন্নতা কতটা তার ব্যক্তিগত প্রবণতা, আর কতটা সময়ের চিহ্ন তা পাঠককে নিশ্চয় ভাবাবে।

নবারুণের মসোলিয়াম এর কার্নিভাল এবং ফ্যাতাড়ু চাকতিদের পুনরুভ্যুদ্যয়


তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেই সময়ে কমিউনিস্ট সোভিয়েত রাশিয়ায় বাখতিন পেশ করলেন তাঁর গবেষণা সনদ ‘র‍্যাবেলিয়াস অ্যান্ড হিজ ওয়ার্ল্ড’। এখানে তিনি আনলেন তাঁর বিখ্যাত সেই কার্নিভাল তত্ত্ব যা পরবর্তীকালে সংস্কৃতি জগতের ভাবনা চিন্তাকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপক মাত্রায় প্রভাবিত করল। বাখতিন কার্নিভাল এর বিশেষ বৈশিষ্ট দেখিয়ে লিখলেন
All were considered equal during carnival. Here, in the town square, a special form of free and familiar contact reigned among people who were usually divided by the barriers of caste, property, profession, and age. The carnival atmosphere holds the lower strata of life most important, as opposed to higher functions (thought, speech, soul) which were usually held dear in the signifying order. At carnival time, the unique sense of time and space causes individuals to feel they are a part of the collectivity, at which point they cease to be themselves. It is at this point that, through costume and mask, individual exchanges bodies and is renewed. At the same time there arises a heightened awareness of one’s sensual, material, bodily unity and community.
নবারুণ যখন ফ্যাতাড়ুদের মত চরিত্র নির্মাণ বা ‘মসোলিয়াম’ এর মত উপন্যাস নিয়ে কথা বলেন, তখন তার প্রেরণা হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন এর কার্নিভাল তত্ত্বের। ২০০৪ এ ভাষাবন্ধন পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসটির আগে পরেও ফ্যাতাড়ু চাকতিদের নিয়ে লিখেছেন নবারুণ। ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক’ গল্পগ্রন্থে যে ধরণের চরিত্র আর আখ্যানের সূচনা হয়েছিল, সেই সূত্রেই এরপর নবারুণের বিখ্যাত ক্লাসিক ‘কাঙাল মালসাট’ লিখিত হয়। ‘মসোলিয়ম’ তারই পরবর্তী অধ্যায়। মসোলিয়ম এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে ভাষাবন্ধন পত্রিকায় ২০১০ এর গোড়া থেকে ধারাবাহিকভাবে বেরোতে শুরু করেছিল ‘মগবগে নভেল’, কিন্তু কালান্তক ব্যাধি ও শেষমেষ নবারুণের অকাল মৃত্যুতে তা অসমাপ্তই থেকে গেল। এই জাতীয় লেখাগুলি কেন লেখেন সে প্রসঙ্গে নবারুণের কৈফিয়ৎ ছিল, “ বাংলায় যাকে বলে আমোদগেঁড়ে, আমি একটু আমোদগেঁড়ে আছি, কার্নিভাল ভালোবাসি। পুজোটুজো এলে আমার প্রচণ্ড আনন্দ হয়। এই যে এত লোক আনন্দ করছে আমি হয়ত তাদের মতো করে করতে পারি না কিন্তু আমার লোভ হয়। হিংসে হয়। এবং মানুষের সামান্যতম আনন্দে আমি খুবই আনন্দিত হই। রাস্তায় একটা ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে – আমি দাঁড়িয়ে দেখি। এই যে মানুষের হাজার দুঃখের মধ্যেও তার বেঁচে থাকা প্রাত্যহিক সেলিব্রেশন – এইটা আমাকে অসম্ভব, মানে কী বলবে মোটিভেট করে। তার প্রাত্যহিক জীবনে সেরকম কোনও কিছু নেই, কিন্তু সে যখন একটা বিড়ি ধরায় তখন সে কিন্তু রাজা। তার এই রাজকীয় ভাবটুকু আমি তার কাছ থেকে গ্রহণ করি। এই celebration of life এইটা কিন্তু আমার কাছে খুব দরকারি একটা ব্যাপার। এইটাই মানে আমাকে অনেকদূর অবধি নিয়ে গেছে মানে কাঙাল মালসাট অবধি নিয়ে গেছে। বা মসোলিয়ম অবধি নিয়ে গেছে। এবং হাজার দুঃখ হাজার কষ্টের মধ্যেও মানুষকে যেভাবে আনন্দের সন্ধান করতে দেখেছি সেটা থেকে আমার মনে হয় আরও বড় এক সেলিব্রেশনের অপেক্ষায় এই কার্নিভালগুলো অ্যারেঞ্জ করা দরকার। যে সেলিব্রেশনের কথা সম্ভবত লেনিন প্রথম বলেছিলেন। ” [নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথাবার্তা/ কবিতীর্থ/ আশ্বিন ১৪১৪, পৃ – ১৭৬]
নবারুণ কার্নিভাল প্রসঙ্গে লেনিনের কথার যে প্রসঙ্গ আনলেন তার সঙ্গে আমাদের সবারই কমবেশি পরিচয় আছে। লেনিন বলেছিলেন বিপ্লব হলো জনগণের উৎসব। নবারুণ ‘কাঙাল মালসাট’ এ ফ্যাতাড়ু চাকতিদের রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াইয়ের যে ছবিটি হাজির করেছিলেন সেখানে জনগণের উৎসব ও প্রতিস্পর্ধার মেজাজটি পুরোমাত্রায় বর্তমান ছিল। সে প্রসঙ্গে এখানে নতুন করে আর আলোচনায় প্রবেশের প্রয়োজন নেই। আগ্রহী পাঠক এই সংক্রান্ত আমাদের আগের আলোচনা দেখে নিতে পারেন। ‘মসোলিয়ম’ এ এসে কিন্তু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্মুখ সমরের বিষয়টিকে আর সেভাবে ফিরিয়ে আনা হয় না, বরং রাষ্ট্র ও প্রশাসন যন্ত্রকে বোকা বানানো, তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলার একটা আয়োজন এখানে আমরা দেখতে পাই।
‘কাঙাল মালসাট’ এ ভদি বাহিনীর তেলের খনি বের করে তেল উত্তোলনের যে স্বপ্ন ছিল তা সফল হয় নি। কিন্তু টাকা যোগাড় করে মস্তি করার, উৎসব করার, কার্নিভালের মধ্যে থাকার আকাঙ্ক্ষাটা বজায় থেকে গেছে। ‘মসোলিয়ম’ এ মমি সংক্রান্ত ব্যবসা ফাঁদার মজার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এবং তা সাফল্যও পায়। ভদি বাহিনী ট্রাক ভর্তি টাকা কামাতে সফল হয়। ভদি একটি কাঁচের বাক্সে মমি হয়ে শুয়ে থাকে দিনের কয়েক ঘন্টা। নট নড়ন চড়নের এক যোগ বিদ্যা নাকি সে আয়ত্ত করেছে। ঘরে বাজতে থাকে বৈষ্ণব কীর্তনের আদলে ভদি ভদয়ে নমঃ ও অন্যান্য ভদী সঙ্গীত। আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল পুরন্দরের ভদি অভিধান রচনার কাজ। কোলকাতার কালীঘাটে এই মমি দেখতে লোকের ভীড় লেগে যায়। এজন্য কোনও বিজ্ঞাপণেরও দরকার হয় নি। লোকমুখে দাবানলের মতো এ খবর ছড়িয়ে যায়, গণেশের দুধ খাবার মিথকে অনেক পেছনে ফেলেই। শাসক দলের কমরেড আচার্য গোটাটাকে বুজরুকি হিসেবে বরাবর দেখে এসেও অবশেষে মমিচক্রের ‘হাইকমাণ্ড’ এর সঙ্গে একটা আপোষ রফার মধ্যে দিয়ে মুখরক্ষার জায়গা খোঁজার রাস্তায় যেতে বাধ্য হন। ততক্ষণে অবশ্য তার পুলিশ কমিশনার ও অনুচরেরা ভদির দলে ভিড়ে গেছে।
‘মসোলিয়ম’ এ নবারুণ বাংলার সংস্কৃতি জগৎ নিয়ে স্বভাবসিদ্ধ কিছু টীকা টিপ্পনি হাজির করেন। একদিকে বজরা ঘোষ এর মতো ঔপন্যাসিককে আনেন যার লেখা ব্যতিক্রমী কিন্তু সাহিত্য জগৎ মোটেই তাকে কল্কে দেয় না। ব্যক্তিগত জীবনেও চরম ভাগ্যবিড়ম্বিত এবং সাহিত্যিক হিসেবেও এলিট মহলে নিতান্ত ব্রাত্য বজরা বাধ্য হয়ে নিজেই নিজের কল্পিত সাফল্যের অনেক ফ্যান্টাসি রচনা করে। এরই উল্টোদিকে থাকে শক্তিশালী ক্ষমতাবান অধ্যাপক ও সমালোচকের দল যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন পিশাচদমন পাল। ভদিবাহিনীর হুড়কো খেয়ে তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারে নামে মমির পক্ষ অবলম্বন করে। সংবাদপত্রে তাদের চিঠি প্রকাশের মত ঘটনার মধ্যে দিয়ে চাপা স্যাটায়ার তৈরি করেন নবারুণ। বুদ্ধিজীবীরা যে আসলে মূলত আজ্ঞাবহ দাস এবং কখনো রাষ্ট্রের বা কখনো অন্য কোনও শক্তিধরের হাতের তামাক খেয়ে বিবেক বুদ্ধি চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে তোষামদে মত্ত হতে স্বতঃআগ্রহী, সেটা নবারুণ তার বিভিন্ন আখ্যানে বাববার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনেন। এই রেকারেন্ট মোটিফটি এখানেও আছে।
নবারুণের প্রথম উপন্যাস ‘হারবার্ট’ এ মৃতের সহিত কথোপকথনের কেন্দ্রীয় ভূমিকা ছিল। সেদিক থেকে দেখলে মৃত্যুকে নিয়ে ব্যবসা মসোলিয়াম এই প্রথম নয়। আর দু ক্ষেত্রেই আমরা দেখি প্রতিক্রিয়া আসে স্টালিনপন্থী ভাবনা চিন্তার জগতের লোকেদের থেকে। যুক্তিবাদী সমিতির প্রবীর ঘোষের এক ছায়া চরিত্র হারবার্টকে মৃতের ব্যবসা নিয়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল, যার পরিণতিতে হারবার্ট শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে। ‘মসোলিয়াম’ এ শাসক দলের প্রধান,  বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছায়া চরিত্র কমরেড আচার্যর দিক থেকে প্রতিক্রিয়া আসে। এক্ষেত্রে অবশ্য পশ্চাদপসরণের পালাটা কমরেড আচার্যের দিক থেকেই হয় এবং ‘কাঙাল মালসাট’ এর মতো ‘মসোলিয়ম’  এও এই চরিত্রটিকে ঘিরে যথেষ্ট ঠাট্টা তামাসা করেন নবারণ।
ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তায় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের একান্ত অনুসারী, মার্কসবাদ লেনিনবাদে আমৃত্যু বিশ্বাসী নবারুণ বস্তুবাদের পক্ষ থেকে ভাববাদের বিরুদ্ধে তোলা প্রশ্নগুলিকে নিয়ে কেন এত আগ্রাসী স্যাটায়ার তৈরি করেন, সেটা অনেককে মাঝে মধ্যেই ভাবায়। হয়ত বিষয়টিকে বস্তুবাদ ভাববাদ দ্বন্দ্বের জায়গা থেকে এখানে দেখতেই চান না নবারুণ। শিষ্ট জগতের ভদ্র প্রতিক্রিয়ার উল্টোদিকে সাব অল্টার্নদের নিজস্ব কার্নিভাল এর সেলিব্রেশন হিসেবেই তিনি দেখেন ব্যাপারটিকে। হারবার্টেও ‘মৃতের সহিত কথোপকথন’ এর অফিসটিকে ঘিরে পাড়া বেপাড়ার সাব অল্টার্নদের আড্ডা জমত। ভদির মমির পরিকল্পনা ও রূপায়ণের সঙ্গে যুক্তরা তো একই সঙ্গে সাব অল্টার্ন ও রেবেল। মনে হয় এখানে চেনা ছকের প্রগতি প্রতিক্রিয়া বস্তুবাদ ভাববাদের দর্শনের দ্বন্দ্বকে যান্ত্রিকভাবে দেখতে চান নি আখ্যানকার। রাষ্ট্র ও তার অঙ্গগুলির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ও তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা, তাকে বোকা বানানোর নানা আয়োজনের কার্নিভাল এর মধ্যেই আখ্যানের মেজাজটা ধরে রাখতে চেয়েছেন।

নবারুণের লুব্ধক ও প্রাণমণ্ডলের গৃহযুদ্ধ


লুব্ধক নবারুণের একেবারেই অন্যরকম এক লেখা যেখানে গোটা আখ্যানের কেন্দ্রে থাকে অসংখ্য কুকুর। সাধারণভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্পেষণ ও তার প্রতিক্রিয়ার যে ছকটি নবারুণ তার লেখায় রেকারেন্ট মোটিফ এর মত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনেন,যা শেষপর্যন্ত তার সিগনেচার স্টাইল হয়ে ওঠে,তা এখানেও বিদ্যমান। তবে দমন ও প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রে এখানে নিম্নবর্গের মানুষেরা নয়, আছে কুকুরেরা। নবারুণকে পড়তে পড়তে আমরা লক্ষ্য করতে থাকি ওয়াশিংটন সনসেন্সাস ভিত্তিক আগ্রাসী ডেভেলপমেন্টাল হেজিমনির চেহারাটি তিনি তাঁর আখ্যানগুলিতে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনেনকাঙাল মালসাট,অটো, ভোগীর মত নানা রচনায় উন্নয়ন প্রায়শই নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে উন্নয়ন সন্ত্রাসের নামান্তর হয়ে দাড়ায়। লুব্ধক এক অর্থে এদেরই সগোত্র। মানুষের জায়গায় কুকুরদের সামনে রেখে আখ্যানের পরিকল্পনা হলেও মৌলিক প্রশ্নটি থেকে পাঠককে কিছুতেই সরতে দেন না নবারুণ। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণি নিরপেক্ষ উন্নয়ন বলে আদৌ কিছু হওয়া সম্ভব কিনা সেই আত্মসমীক্ষার দিকে উন্নয়ন স্বপ্নের মৌতাতে বুদ পাঠককে বারবার ঠেলতে থাকেন আখ্যানকার। সেইসঙ্গে লুব্ধকে এসে উন্নয়ন এর মধ্যে মানব সর্বস্ব দিকটিকে প্রশ্নায়িতও করেন তিনি। অসংখ্য জীবকুলের আবাসভূমি এই পৃথিবী থেকে ক্ষমতাবান মানুষের মর্জিমাফিক পরিকল্পনার জন্য বাকিদের ঝরে যেতে হবে কেন,এই প্রশ্নকে উচ্চবিত্তের উন্নয়ন বিলাসের প্রয়োজনে নিম্নবিত্তদের উচ্ছেদ এর বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে দেন নবারুণ।
লুব্ধকের মতো একটি আখ্যানের পরিকল্পনা তিনি কেন করেছেন তা জানাতে গিয়ে গ্রন্থাকারে উপন্যাসটি প্রকাশের সময় (দিশা সাহিত্য পত্রিকায় ২০০০ সালের শারদ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশের ছয় বছর পর ২০০৬ সালে অভিযান প্রকাশনী থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়) লেখা মুখবন্ধে তিনি জানান
“একটি কুকুর উপকথা লেখার পরিকল্পনাটি আমার দীর্ঘদিনের, যার পরিণতি ‘লুব্ধক’। কুকুর, বেড়াল, পাখি, মাছ – এদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছোটোবেলা থেকেই। তারা যেমন আনন্দ দিয়েছে আমাকে, তেমনি দুঃখ দিয়েছে চলে গিয়ে। শিখিয়েছে আমাকে অনেক কিছুই যা ঠিক বই পড়ে শেখা যায় না। আমার ছোটবেলার সঙ্গী জিপসির প্রতি আমার যে ঋণ থেকে গিয়েছে তা শোধ করার চেষ্টা হিসেবেও লেখাটিকে দেখা যেতে পারে। প্রাণমণ্ডলের অধিকার একা মানুষেরই নয়, সকলেরই। এই অধিকারের মধ্যেই নিহিত আছে প্রাণ ও মৃত্যুর নিয়ত ভারসাম্যের এক সমীকরণ যাকে বিঘ্নিত করলে মানুষের লাভের চেয়ে ক্ষতি হবার সম্ভাবনাই বেশি।”
লুব্ধক আর একটি আখ্যান খেলনানগর এর সঙ্গে যুগ্মভাবে যখন হিন্দি অনুবাদে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল তখন সেখানে সালভাদোর দালির স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আঁকা Premonition of Civil War ছবিটি প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই ব্যবহার বিশেষ তাৎপর্যের। খেলনানগরে আণবিক পরীক্ষার জন্য হিমশীতল পরিকল্পনায় একটি প্রায় পরিত্যক্ত জনবসতিকে কিছু মানুষ সহ বেছে নিয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্র। আর লুব্ধকে আমরা দেখতে পাই কোলকাতাকে ঢেলে সাজানোর জন্য শহরের কুকুরদের বিশেষ উপদ্রব বলে রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তারা মনে করেন। কুকুর নিধনের জন্য নানা পরিকল্পনা ছকা হতে থাকে। এর কোন কোনটি আবার হিটলারের নাত্‍সী জমানায় ইহুদী নিকেশ পরিকল্পনার আদলে তৈরি হয়। নবারুণ তীব্র স্যাটায়ারে দেখান শাসক একবার তার অপরকে নির্মাণ করে নিতে পারলে তার নিকেশ প্রক্রিয়াকে কত ব্যাপক ও ভয়ানক করে তুলতে পারে। শেষপর্যন্ত অবশ্য খেলনা নগরের মত হিমশীতল মৃত্যু আসে না লুব্ধকে, প্রতিবাদ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে তীব্রতম প্রক্রিয়াগুলিকে বিরতি দিয়ে একটি আপাত নরম কিন্তু কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ঠিক যেভাবে গণতন্ত্র শোভিত বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি ভিয়েতনাম বা আবু ঘ্রাইব এর উদাহরণগুলি স্বত্ত্বেও চেষ্টা করে নাজী বা ফ্যাসিবাদী জমানার গণহত্যাগুলির প্রত্যক্ষতাকে সাধারণভাবে কিছুটা বদলে নিতে। নবারুণ দেখান ওভার্ট নয় কভার্ট অপারেশন এর মন্ত্র নিয়েছে তারা লুব্ধকে শেষপর্যন্ত কুকুরগুলিকে সরাসরি মেরে না ফেলে ধরে ধরে আবদ্ধ পিজরাপোলে পাঠানো হতে থাকে। সেখানে খাবার আর জল বন্ধ করে ধীরে ধীরে তাদের শুকিয়ে মারার পরিকল্পনা হয়। কুকুর ধরার পর্ব শুরু হলে ইতিউতি কিছু নিম্নবর্গীয় মানুষ প্রতিবাদ জানায়। আর নবারুণ বোধহয় সুশীল সমাজের অতি ভদ্র দায়হীন অকার্যকরী নিয়মরক্ষার প্রতিবাদগুলিকে ব্যঙ্গ করেই আখ্যানে কিছু মানুষকে দিয়ে বলান কুকুর যেন এমনভাবে ধরা না হয় যাতে এই দৃশ্য অল্প বয়সের ছেলে মেয়েদের ওপর প্রভাব ফেলে। কুকুর ধরা চলতে থাকে মূলত ছেলেমেয়েদের স্কুল চলাকালীন সময়ে।
প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে আক্রান্ত তার ওপর দমনের প্রতিক্রিয়া জানাবেই এটা নবারুণ তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে সব সময়েই দেখিয়ে এসেছেন। আমাদের সময়ের অন্যতম ক্লাসিক কাঙাল মালসাট চাকতি আর ফ্যাতাড়ুদের যে শ্রেণিযুদ্ধকে দেখায় ঠিক সেইমাত্রাতে বা পদ্ধতি না হলেও লুব্ধকে কুকুরেরাও নীরব মৃত্যুকে মেনে নেয় না। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে শক্তিশালী মানুষ ও তার যান্ত্রিক ব্যবস্থাপণাকে অতিক্রম করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়। প্রথম দিকে বিচ্ছিন্নভাবে দু একটি কুকুর পালায় ,তারপর তারা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে। এমনকী বাচার এই লড়াইয়ে তারা বেড়ালদের সঙ্গে স্বভাবসিদ্ধ বৈরিতা পেরিয়ে গড়ে তোলে মৈত্রিভিত্তিক যুক্তফ্রন্ট।
ইতিহাস পুরাণের আনুবিশ থেকে মহাকাশের প্রথম কুকুর লাইকা পর্যন্ত ইতিহাসখ্যাত সকলেই কুকুরদের শহর ছেড়ে মহানিষ্ক্রমণের পর্বে প্রেরণা হয়ে ওঠে। মহাকাশের কুকুর মণ্ডল থেকে আসা বার্তাকে আত্মস্থ করে বয়োবৃদ্ধ কুকুরেরা। ধরা পড়া এড়ানোর সংগ্রামী পর্বের সূচনায় তাদের কয়েকজনই স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে নিষ্ক্রমণ সংগ্রামে ভ্যানগার্ড শহীদের ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
আখ্যানের শেষপর্বে এসে এক অসামান্য দৃশ্যকল্প তৈরি করেন নবারুণ। লক্ষ লক্ষ কুকুরের এক বিশাল মিছিল শহরের সমস্ত রাস্তাঘাট যান চলাচল আর প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে থমকে দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের কৌতূহল তৈরি করে শহর ছেড়ে কোনও অজানা গন্তব্যে পাড়ি দিতে থাকে। যে কুকুরদের পারস্পরিক বিবাদকেই চেনা চোখ দেখতে অভ্যস্ত এই সংগবদ্ধ বিশাল মিছিল তাদের কাছে অদৃষ্টপূর্ব এবং অচিন্তনীয়ই বটে। নবারুণ যেন ইপ্সিত কিন্তু অধরা এক প্রলেতারিয় মহামিছিলের রূপকল্প ভাসিয়ে দেন দীক্ষিত পাঠকের অন্তরে। এই উন্নয়ন সন্ত্রাসের দিনগুলিতে আধুনিক শ্রেণিযুদ্ধের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলে। উপন্যাসের শুরু এবং শেষে উল্কাপাতের যে মহাজাগতিক বিস্ফোরণ এর মধ্য দিয়ে শহর ধ্বংসের ঠিক সাত ঘন্টা আগে কুকুরদের নিরাপদ মহানিষ্ক্রমণের কথা বলা হয়েছে তা যেন এক পোয়েটিক জাস্টিস। ক্ষমতার গজদন্তমিনারে আসীন শক্তিমানের পরিকল্পনা ও দম্ভ বিলাসের মুখে কাল নির্ধারিত এক নির্ণায়ক ধাক্কা।

ভোগীর সীমাবদ্ধতা থেকে ফ্যাতাড়ুর উৎসমুখে


রচনাকালের দিক থেকে নবারুণের দুটি মেজর নভেলের, ‘হারবার্ট’ ও ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’র মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ‘ভোগী’। হারবার্ট প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ এ প্রমা পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। তার পরের বছর ১৯৯৩ তে বারোমাস পত্রিকার শারদসংখ্যায় প্রকাশিত হয় ‘ভোগী’। এর দুবছর পর ১৯৯৫ এর ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকার শারদসংখ্যায় আত্মপ্রকাশ করে ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’। ‘হারবার্ট’ নিয়ে সমকালীন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে বিপুল আলোড়নের কথা আমরা জানি, ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ নিয়েও উতরোল কম হয় নি এবং তাকে নিয়ে বিশিষ্ট থিয়েটার গ্রুপ মঞ্চসফল নাটকও করেছেন। তুলনায় ‘ভোগী’ যেন খানিকটা নিষ্প্রভ। শুধু যে আমাদের মতো পাঠকদের কাছে এটা মনে হয়েছে তা নয়, কথাকার নবারুণেরও সম্ভবত তাই মনে হয়েছিল। আমরা তো লক্ষ্যই করি গ্রন্থ হিসেবে ‘ভোগী’র আত্মপ্রকাশ যথেষ্ট বিলম্বিত। ১৯৯২ এ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হারবার্ট’ ১৯৯৩ এই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হচ্ছে, ১৯৯৫ এ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ও তার ঠিক পরের বছরেই ১৯৯৬ সালে বইয়ের চেহারা নিচ্ছে। কিন্তু ১৯৯৩ এ পত্রিকায় শারদসংখ্যায় প্রকাশের পর দীর্ঘদিন ‘ভোগী’ আর গ্রন্থাকারে আত্মপ্রকাশ করে নি, অবশেষে প্রায় দেড় দশকের ব্যবধান পেরিয়ে অন্য একটি উপন্যাস ‘অটো’কে সঙ্গে নিয়ে সে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। নবারুণ তাঁর বিভিন্ন আত্মকথনেও এ সংক্রান্ত তাঁর ভাবনাচিন্তা ব্যক্ত করেছিলেন। উপন্যাসটি প্রকাশের পরের বছরেই নবারুণ দেবেশ রায়ের সঙ্গে এক কথোপকথনে (মে ১৯৯৪, প্রতিক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত) জানিয়েছিলেন, “ভোগীর বর্তমান গঠনে আমি খুশি নই, সেটা আমি বদলাব। ...কেউ না দেখলে বানাতে পারবে না। আবার বানানোরও একটা জায়গা আছে। আমার মনে হয়েছে ভোগীতে সেই বানানোর দুর্বলতাই ঘটেছে।” আমরা জানি ইপ্সিত বদলের সেই সুযোগটা নবারুণ আর পান নি বা নিতে চান নি ভিন্ন কোনও কারণে। পত্রিকায় প্রকাশের চোদ্দ বছর পর ভোগী অপরিবর্তিতভাবেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তখনো অবশ্য ভোগীকে নিয়ে অতৃপ্তির ব্যাপারটা ছিলই। ‘অটো’ ও ‘ভোগী’ একত্রে প্রকাশের মুখবন্ধে নবারুণ লিখেছিলেন, “ দুটি লেখাই আমার নিজের প্রিয়। অনেকের নয়। কেউ কেউ বলেছে যে লেখাদুটিকে বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে বইবন্দি করার সুবাদে ফিরে পড়তে গিয়ে মনে হল সেটা ঠিক হবে না। টেনে বাড়িয়ে দুর্বলতা ঢাকা যাবে না, খুব একটা সঙ্গতও মনে হচ্ছে না।”
‘ভোগী’ কে নিয়ে লেখক পাঠকের এই যে অতৃপ্তি কোথায় তার উৎস ? সেই উত্তরটা এখানে খুঁজতে চাইবো আমরা। আমাদের মনে হয়েছে শুধু ‘ভোগী’ বা তার দুর্বলতাকে বোঝার জন্য নয়, নবারুণ এর কথনবিশ্বের একটা সূত্র আবিষ্কার করতে এই সন্ধানের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে।
আমরা যারা নবারুণের বিভিন্ন লেখার আগ্রহী পাঠক তারা জানি নবারুণ একটা নির্দিষ্ট বিশ্বাসের জায়গা থেকে লেখেন। হারবার্ট সংক্রান্ত প্রথম আলোচনায় আমরা সে প্রসঙ্গকে এনেছিলাম, এবার আবার তাকে একটু মনে করি। নিজের লেখা সম্পর্কে তাঁর সেই অমোঘ উক্তি, "আমি লেখার ব্যাপারটা যেভাবে বুঝি সেটা নিছক আনন্দ দেওয়া বা নেওয়া নয়। আরো গভীর এক অ্যালকেমি যেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েছে।"আমরা জানি একটা বিকল্প রণনীতি ছিল তাঁর সুখপাঠ্য আখ্যান থেকে নিজের লেখাকে পৃথক করার। একটা গভীর বিশ্বাস থেকে সেই রণনীতি তৈরি হয়েছিল। "পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্টের মৃত্যু হলেও ... সারা দুনিয়া জুড়ে কমিউনিস্টরা ফিরে আসবে। হ্যাঁ আসবে।তবে তার জন্যে আগামী সতেরো বছর বা তারও বেশি সময়ের প্রত্যেকটি ঘণ্টা ও প্রত্যেকটা মিনিট কাজে লাগাতে হবে। সারা পৃথিবী জুড়ে কমিউনিস্টরা ফিরে আসবে। আসবেই। আর দশ নয়, দশ হাজার দিন ধরে দুনিয়া কাঁপবে।" সাহিত্যের কোন ভূমিকা পালনের জন্য নবারুণ কলম ধরেছিলেন তা জানিয়ে একটি গল্প সংকলনের ভূমিকায় তিনি বলেছিলেন, " মানুষের এগিয়ে চলার, শোষণমুক্তি ও সমাজব্যবস্থা পাল্টানোর মডেল, পুঁজি ও প্রতিক্রিয়ার আঘাতে ও বামপন্থীদের আবশ্যিক আত্মসমীক্ষার অভাবের কারণে অনেকটাই তছনছ হয়ে গেছে। যে শতক সবচেয়ে আশা জাগিয়েছিল সেই শতক শেষ হচ্ছে অবসাদে বিষাদে যন্ত্রণাজর্জর অবস্থায়। আমি দৈনন্দিনতায়, প্রত্যহ নিকটে ও দূরে, নিয়ত যা দেখতে পাই তা হল পরতে পরতে স্তরে স্তরে সমাজের ভিন্ন ভিন্ন বর্গের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শোষণ, নতুনতর ঔপনিবেশিকতা ও সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদের অমানুষীকরণের দেখা না দেখা হাতকড়া ও চোখভুলোনো ঠুলির ভার। সামন্ততন্ত্র বা পুঁজিবাদের বালক বয়সের প্রত্যক্ষ নিষ্ঠুরতার চেয়েও এ যেন অধিকতর মারাত্মক, জঘন্য ও অপমানজনক। এই দলিত মথিত মানুষ ও তাদের জীবনের এক বিচিত্র ক্যালেইডোস্কোপের মধ্যে আমার জীবন কাটছে। চারপাশে তাই আমি দেখি। কিন্তু চূড়ান্ত নিরিখে এই বাস্তবকে আমি চিরস্থায়ী বলে মানি না। বাস্তবকে পাল্টাতে হবে। হবেই। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চেতনা তৈরি করার ক্ষেত্রে সাহিত্যের অবশ্যই একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে"
নবারুণের আখ্যানগুলির মুখোমুখি হয়ে আমরা দেখি নবারুণ এর বিভিন্ন লেখায় সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, সোভিয়েত সমাজবাদের মডেলটির পতন, বিশ্বজুড়ে লুঠেরা পুঁজির অপ্রতিহত গতি ও তাকে লাগাম পড়ানোর চিন্তাভাবনা তথা পথসন্ধান পুনরাবৃত্ত এষণা বা রেকারেন্ট মোটিফ হিসেবে ঘুরেফিরে আসছে। ৮৯ এ পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত সমাজবাদের পতনের পর থেকেই নবারুণের উপন্যাসগুলি আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় রাজনীতির পরিবর্তন, সমাজের পরিবর্তনকে নবারুণ যেমন তাঁর উপন্যাসে আনতে থাকেন, তেমনি এর মোকাবিলা করার রণনীতিও খুঁজতে থাকেন। ‘ভোগী’র আগে পরে যে দুটি উপন্যাস লেখা হয়েছিল, সেই ‘হারবার্ট’ বা ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ তে এই মোকাবিলার জন্য নবারুণ বেছে নিয়েছিলেন আড়াই দশক আগের এক আলোড়ন তোলা বিপ্লবপ্রচেষ্টাকে, যার রেশ তখনো এখনো এবং সম্ভবত আরো দীর্ঘ দীর্ঘদিন স্বপ্ন দেখার মহড়া হিসেবে উজ্জ্বল থাকবে। পাঠক বুঝতে পারছেন আমরা নকশালবাড়ি আন্দোলনের কথাই বলছি। ‘হারবার্টে’র বিনু বা ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’র রণজয় নকশালবাড়ি আন্দোলনের মানুষ। তাদের ঘিরে নবারুণ রাষ্ট্র এবং এই শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কামান দাগার এক তৈরি ডিসকোর্সকে পেয়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানকে মোকাবিলা করার একটা ভিন্ন দায় কমিটেড লেখকের থাকবেই এবং নবারুণ সেই দায় গ্রহণও করেছেন।
২০০৭ এ রচনার দেড় দশক পর গ্রন্থ প্রকাশকালে ‘ভোগী’র মুখবন্ধে নবারুণ জানিয়েছিলেন, “একই ধাঁচের লিখতে যে আমার ভালো লাগে না, ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির মুন্সিয়ানা যে আমার নেই, সেটা বোধহয় আমার পাঠকেরা এতদিনে জেনে ফেলেছে।” আমাদের মনে হয় হারবার্ট এর পর নবারুণ ভাবতে চেয়েছিলেন নকশালবাড়ির ব্যবহৃত অনুষঙ্গর বাইরে গিয়ে সমকালের প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা কীভাবে করা যেতে পারে। মোকাবিলার আকাঙ্ক্ষাটা ভোগীতে নিঃসন্দেহে স্পষ্ট ও সরাসরি। আমরা দুটি উদ্ধৃতির দিকে খেয়াল করবো –
১.
“আর এক রাউন্ড গ্লোবাল লড়াই হবে। ক্যাপিটালের সঙ্গে হিউম্যানিটির লড়াই। মার্কসবাদ নামক শর্ট লিভড রিলিজিয়নটি যা পারল না। ডু ইউ নো একসময় – যখন এস এফ করতাম তখন ওঃ কত স্বপ্ন ছিল ... দুনিয়াটা কে চালাচ্ছে বলতো ? ক্লিন্টন, কোল, মেজর, নাকি ওই জাপানি লিডারগুলো – ইমপসবলস নেমস ? ওরা ঘেঁচু । দুনিয়াটা চালাচ্ছে – জি এম, আই বি এম, পেপসিকো, জেনারেল ইলেকট্রিক, কাইজার, শেল, ফোকসভাগেন, এক্সস্কন, - এরকম কয়েকশো মাল্টিন্যাশানালস। ভাবতে পারিস ফার্স্ট ইন্টারন্যাশানাল সিটি কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট বলছে, ‘কনজিউমার ডেমক্রেসি ইজ মোর ইমপর্টান্ট দ্যান পলিটিকাল ডেমক্রেসি। ... দুনিয়ার মানুষ মেনে নেবে ? ছিঃ ভাবা যায় না। ... লড়বে। না পারলে মরে যাবে। ইন প্রেটেস্ট মরে যাওয়াও ইজ্জতের”।
২.
“রজতদার সঙ্গে তখন আই এস আই এর অর্থনীতির অধ্যাপক পুরুষোত্তম চ্যাটার্জির জোর তর্ক চলেছে। পুরুষোত্তম করেছেন কি রবিন ব্ল্যাকবার্ন সম্পাদিত ‘আফটার দা ফল – দা ফেলিওর অফ কমিউনিজম অ্যান্ড দা ফিউচার অব সোশালিজম’ বইটি পড়েছেন এবং সবিশেষ প্রভাবিত হয়েছেন। বিশেষত এরিক হবসবম, ফ্রেডরিক জেমসন এবং র‍্যালফ মিলিব্যান্ডের লেখাগুলো তাঁকে ভাবাচ্ছে। এর কোনও কিছুই রজতদাকে ইমপ্রেস করে নি।
-  দ্যাখো পুরুষোত্তম, আমার সহজ কথাটা হল এই নিউ লেফট মার্কা অ্যানালিসিসগুলো আমি মেনে নিতে পারি না – বলতে পারো যে সেটা আমার লিমিটেশন – যাই হোক আমার কথা হল তুমি যেটাকে বলছ ফেলিওর আমি সেটাকেই বলছি বিট্রেয়াল। ভুলচুক কটা হয়েছে ? হ্যাঁ, একসময়ে মনে হয়েছে গাইড টু অ্যাকশানের বদলে ডগমার দিকে পাল্লা ভারি। সো হোয়াট! কমরেড স্তালিন বা কমরেড মাও তো আর আর্মচেয়ার থিওরেটিশিয়ান ছিলেন না, তাঁদের এত বড় বড় কাজ করতে হয়েছিল – তাতে একটু আধটু গলদ থাকতেই পারে –
-  কিন্তু সেটা ঠিক থাকলে এরকম হাম্পটি ডাম্পটি শো হতো না রজতদা।
-  তাহলে চায়নাতে হল না কেন ? ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কিউবা কী করে লড়ে গেল। দ্যাখো, ফান্ডামেন্টাল টেনেটস বলতে আমরা যা বুঝি – ওয়ার্কিং ক্লাসের ফিলজফিক্যাল আউটলুক, ডায়ালেক্টিকাল অ্যান্ড হিস্টরিকাল মেটেরিয়লিজম, মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট পলিটিকাল ইকনমি, ক্লাস স্ট্রাগেল, যেটা মোটিভ ফোর্স, তারপর শ্রমজীবী মানুষের স্টেট, শ্রমিক শ্রেণির পার্টি গড়ার প্রয়োজনিয়তা – ক্যাপিটালিজম থেকে সোসালিজম হয়ে কমিউনিজম – এর একটাও ইনভ্যালিড নয় -”
আমাদের মনে হয় ‘ভোগী’তে যে বিষয়টা কেন্দ্রে রেখে উপন্যাসটা তৈরি করতে চেয়েছিলেন নবারুণ, সেই কনজিউমারিজম এবং তার মোকাবিলা –‘কনজিউমার ডেমক্রেসি ইজ মোর ইমপর্টান্ট দ্যান পলিটিকাল ডেমক্রেসি’ এই ভাববিশ্বের মোকাবিলা - সেটার জন্য উপযুক্ত আবহ তিনি খুঁজে পান নি। ‘ভোগী’র মত খানিকটা দুর্গেয় রহস্যময়, খানিকটা সাধু ধরণের চরিত্রকে দিয়ে আধুনিক বিশ্বজনীন কনজিউমারিজম এর মোকাবিলা সম্ভব কিনা সেটার চেয়েও বেশি গুরূত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল ভোগীকে, তার আদর্শটাকে, লড়াইটাকে সেভাবে উপন্যাসে এস্টাবলিস্ট করা গেল কিনা। আমাদের মনে হয় এখানেই উপন্যাসের নান্দনিক সমস্যার মূল উৎসটি নিহিত রয়েছে। পলিটিক্যাল নভেল হিসেবে ভোগীর সীমাবদ্ধতা আর নভেল হিসেবে তার দুর্বলতা আলাদা কোনও বিষয় নয়, তা অঙ্গাঙ্গী যুক্ত।
ভোগী একদিকে গ্রাম থেকে শহর দেখতে আসা এক মধ্যবয়স্ক মানুষ যে খোলা এবং ভিন্ন চোখে শহর ও তার সামাজিকতাকে দেখতে থাকে। আবার এই ভোগীর মধ্যেই অতীত ভবিষ্যৎ বর্ণনার মতো কিছু অতিলৌকিক ক্ষমতাও যুক্ত করেন নবারুণ। যদিও এই অতিলৌকিক ক্ষমতা খানিকটা হস্তরেখা বিশারদদের মতো ব্যক্তিগত ভাগ্যগণনাতেই সীমায়িত থেকে যায়, বঙ্কিমের আনন্দমঠের সত্যানন্দের মতো দেশকাল ভাবনার কোনও দার্শনিক উচ্চতা তাতে নেই। ফলে উপন্যাসের রাজনৈতিক বয়ান এ ভোগী কোনও সন্দর্ভ সংযোজন করে না। রজত পুরুষোত্তমের রাজনৈতিক ডিসকোর্স সংক্রান্ত যে কথোপকথনটি আমরা উদ্ধৃত করেছি, সেটি চলার সময় ভোগীও সেখানে উপস্থিত ছিল কিন্তু আগাগোড়া নীরব শ্রোতার ভূমিকা নিয়েই। আসলে সে কতটা কনজিউমারিজম এর অ্যান্টিডোট আর কতটা উপন্যাস বর্ণিত ‘এখন যেটা চলছে মিথিল যেটাকে বলে এথনিক ফেজ’ তার একটা রোমান্সভিত্তিক অনুসন্ধান – সেটা নিয়েই সংশয় জাগে।
উপন্যাসের প্রথম দিকে যখন ভোগীকে পরিচয় করানো হচ্ছে পাঠকের সঙ্গে তখন মিথিলের তথাকথিত এথনিক ফেজের ‘প্রধান গাইডদের অন্যতম’ অভিমান্য মিথিলকে জানিয়েছিল – ‘ ভোগী কে জান তো ? সে করে কি তোমার কয়েকদিন মাত্তর থাকে। এর মধ্যে ভোগ করে। তারপর বলি হয়ে মরে যায়।
-  মরে যায় ? কেন ?
-  কেন আবার কি। চারিদিকে এত অনাচার, অত্যাচার, ধম্মলোপ, খুন-খারাপি, চোপরদিন চুরিচামারি – এই অনাসৃষ্টি দূর করার জন্যই ভোগী আসে, তারপর যা বললাম – আত্মঘাতী হয়।’
আখ্যানে আমরা পরে দেখেছি ভোগী সত্যই আত্মঘাতী হল, কিন্তু অনাসৃষ্টি দূর করার সঙ্গে তার সম্পর্কটি, যেটি সম্ভবত এই উপন্যাস লেখায় নবারুণকে প্রণোদিত করে থাকবে, শেষপর্যন্ত স্থাপিত হলো না। এমনকী গোটা আখ্যানটিকে শেষ পরিচ্ছেদে হঠাৎ একটা ফিল্ম উইথইন এ টেক্সট হিসেবে দেখিয়েও এর কোনও সমাধান করা গেল না। অভিমান্য বলেছিল ‘ভোগী যে সে হয় না। আবার যে কেউ হতি পারে। কে হবে সে এক গূঢ় রহস্য।’ উপন্যাসের কারণেই এই রহস্য উন্মোচনের দায় ছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত উপন্যাসে এ রহস্য ভেদ হয়নি এবং উপন্যাসের নান্দনিক আবেদনকে তা নিঃসন্দেহে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে।
‘ভোগী’র সীমাবদ্ধতা নিয়ে নবারুণ অবশ্যই ভেবেছেন এবং তার প্রকাশ্য কিছু স্বীকৃতি আমরা লক্ষ্যও করেছি। কিন্তু ‘ভোগী’কে পুনর্লিখনের মধ্য দিয়ে নবারুণ এই সীমাবদ্ধতার মোকাবিলা করলেন কিনা সেটা শেষ পর্যন্ত ততটা গুরূত্বপূর্ণ থাকে নি। কারণ পরবর্তী আখ্যানসমূহতে ‘ভোগী’তে উদ্ভূত সমস্যার মোকাবিলা করার কথা নবারুণ ভেবেছেন। পরবর্তী উপন্যাস ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ নান্দনিক সাফল্য পেয়েছে, কিন্তু সেটাই সর্বোচ্চ সিদ্ধি ছিল না। কারণ এখানেও হারবার্টের মতোই আবারো ‘নকশালবাড়ি’ অনুষঙ্গটিকে ঘিরেই সমকালীন প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা করতে হয়েছে আখ্যানকারকে। নবারুণ অবশ্যই চাইছিলেন অতীতের গৌরবের সমস্ত প্রেরণা নিয়েই সমকালকে মোকাবিলা করার জন্য সমকালীন প্রেক্ষাপটের কোনও চরিত্র।  প্রথম ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত উপন্যাস ‘কাঙাল মালসাট’ এই সেই অনন্য সিদ্ধি পেলেন নবারুণ। তার তৈরি ফ্যাতাড়ু আর চাকতিরা অতীতের সমস্ত প্রেরণা আর ক্লাস লাইন সঙ্গে নিয়েই সমকালীন প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা করল এবং বাংলার সংস্কৃতি জগতে একটি চিরায়ত মিথ হয়ে উঠল। ভোগীর নিরীক্ষা এবং সীমাবদ্ধতা সংক্রান্ত ভাবনা নিঃসন্দেহে প্রত্যক্ষে পরোক্ষে এই আধুনিক ক্লাসিকটির নির্মাণে সক্রিয় থেকেছে।