Thursday, September 27, 2018

প্রীতম বসুর পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল


সাহিত্যের পাঠক কম বেশি সকলেই কিন্তু তার মধ্যেই কেউ কেউ জহুরী তাঁরাও পড়েন সাহিত্য, কিন্তু কেবল গল্পের টান বা ছন্দের তানের আকর্ষণে নয় তাদের নজর চলে যায় সৃজনের অন্দরমহলের দিকে। পুঁথির পাতায়, অক্ষর বিন্যাসে প্রাচীন বা মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রামাণিকতা নিয়ে আলাপ আলোচনায় এগুলি অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠে সে আমরা জানি আর এও জানি সাহিত্যের জহুরীদের এইসব পণ্ডিতি আলোচনা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম পেরিয়ে খুব কমই সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ে। কিন্তু কখনো কখনো একটা ব্যতিক্রম তৈরি হয়ে যায়। প্রীতম বসুর মতো প্রবাসী বাঙালি যখন ডুবুরীর মতো ভাষা সাহিত্যের সেই পণ্ডিতি গবেষণার উপাদানকে ব্যবহার করে রোমহর্ষক এক থ্রিলার তৈরি করে দিতে পারেন পাঁচমুড়ার পঞ্চাননমঙ্গলের মতো উপন্যাসে।
আকর্ষনীয় কাহিনী বিন্যাস নিঃসন্দেহে পঞ্চাননমঙ্গল এর আবিস্কার ঘিরে এখানে দানা বেঁধে উঠেছে, কিন্তু সেটাই এই বইয়ের প্রধানতম আকর্ষণ নয়। আমাদের হারানো অতীতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, যা ইউরোপের চোখে জগৎ দেখার বাইরের এক নিজস্বতাকে খুলে দিতে চায়, তাকে আমরা এই আখ্যানে পেয়ে যাই। কীভাবে লেখা হত পুঁথি, কেন কাগজ ব্যবহারে আমাদের এখানে অনেক লিপিকরের দীর্ঘদিনের আপত্তি ছিল, তুলোট পাতা আর তালপাতার পুঁথির পার্থক্য কোথায়, কাহিনীর অন্তর্গত উপাদান হিসেবেই প্রীতম আমাদের তা জানিয়ে দেন। তুলে আনেন বাংলা বর্ণমালার বিবর্তন সূত্রটি। এই আখ্যানের অন্যতম প্রধান দুটি চরিত্রই সারা জীবন ধরে পুরনো সাহিত্য নিয়ে দুভাবে কাজ করেন – সদানন্দ ভট্টাচার্য ও হরু ঠাকুর। প্রথমজনের যদি পারিবারিক ব্যবসা ও নেশা আগ্রহের সূত্রে জহুরীর চোখ তৈরি হয়ে থাকে তো দ্বিতীয় জনের রয়েছে পুঁথি নকলের ও পুঁথি দেখার প্রাতিষ্ঠানিক তালিম। সেইসঙ্গে স্বাভাবিক কবিত্ব যা সহজেই ধরে নিতে পারে পুরনো সাহিত্যের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গীটিকে।
বস্তুতপক্ষে হরু ঠাকুরের আড়াল থেকে লেখক প্রীতম বসু নিজেই এখানে একটি পরীক্ষায় নেমেছেন। চর্যাপদের ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাঝের সময়ের বাংলা ভাষাটি, যার কোনও প্রামাণ্য উপাদান আমাদের হাতে এসে পৌছয় নি অন্ধকার যুগের আড়াল ভেদ করে, সেই ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বাংলাভাষার রূপটি কেমন ছিল। গদ্য আখ্যানের পরতে পরতে মধ্যযুগের পুননির্মিত সেই ভাষায় দীর্ঘ দীর্ঘ পদ্য অংশ মিশিয়ে দেন প্রীতম, বিশেষত কাহিনীর মধ্যভাগ থেকে। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি দক্ষ আখ্যানকার প্রীতমের মধ্যেই কীভাবে মিশে আছে এক ভাষা গবেষক, ছন্দ বিশ্লেষক নিপুণ কবি।
কুসুম কোঁঅলী তার        ছিন্ডিআঁছে অলঙ্কার
ছিন্ডিআঁছে যত মানভএ।
গোরা তার দেহকান্ত        আনুপাম বীর শান্ত
দীঠি কৈল তারি মন জয়।
ছিন্ন নিচোল ছিন্ন কেশ        দেয়ি আপনা বেশ
ঢাকিলেঁ তিরির লাজ
পুরুষের বসনে        জেন বনদেবী বনে
অপরুব তার দেহসাজ।।
বস্তুতপক্ষে ছিরিছাঁদ এর লেখক প্রীতম বাংলা ও সংস্কৃত ছন্দ নিয়ে কতখানি দক্ষ তার প্রমাণ এই আখ্যানের কয়েকটি চকিত মুহূর্তেও আছে। চর্যাপদের চৌপদীর থেকে বাংলা পয়ারের আদি পর্বের নির্মাণটিই শুধু নয়, সংস্কৃত কয়েকটি ছন্দের নিপুণ বিশ্লেষণ তিনি এখানে তুলে আনেন। এখানে আছে তোটক, তূণক, ভুজঙ্গপ্রয়াত প্রভৃতি ছন্দের দৃষ্টান্ত ও আলোচনা।  প্রীতম একটি প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু উত্তর দেন নি। সংস্কৃতে অন্তমিল নেই, বাঙালি তা পেল কোথা থেকে ? হয়ত মুণ্ডা ভাষার আলোচনা ও বাংলার ওপর তার প্রভাব থেকে এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে এগনো যায়। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ
পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের কাহিনীটি আকর্ষনীয়। গুডরিডস থেকে তা হয়ত অনেকেই পড়ে নিয়েছেন।
সদানন্দ ভট্টাচার্য পাঁচমুড়ো গ্রামের সঙ্গতিহীন জমিদার। কিন্তু বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং পুঁথিপাটা নিয়ে ভদ্রলোকের বেশ নাড়াঘাঁটা আছে। বিদেশ থেকে এক ভদ্রলোক আসেন ওঁর কাছে,যাঁর নাম মিঃ ধাড়া। এঁর নাকি লন্ডনে একটা মিউজিয়াম আছে, সেখানে তিনি বাংলা সাহিত্যের পুরোনো সব পুঁথি সংগ্রহ করে রাখেন। এই পুঁথির কাজেই তাঁর এদেশে আগমন এবং সদানন্দ ভটচায্ এর কাছে নাড়া বাঁধা। কালাচাঁদ নামে এক পুঁথি চোর ধাড়াকে চন্ডীদাসের এক নকল পুঁথি বিক্রী করতে এসে সদানন্দের হাতে ধরা পড়ে। সদানন্দ যখন পুঁথির নকলনবীশীর ব্যাপারে জ্ঞান দিতে ব্যস্ত, সেইসময় খবর পাওয়া যায়, পাঁচমুড়ো গ্রামের প্রায় মজে যাওয়া পুকুর চয়নবিলের নীচে থেকে নাকি কিছু পাথর পাওয়া গেছে, যাতে পুরোনো কিসব অক্ষর খোদাই করা আছে। পাথরের ওপর খোদাই করা লেখা পাঠ করে সদানন্দ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর বাংলা ভাষায় এক অনন্য রচনার অংশবিশেষ। এই পঞ্চাননমঙ্গলের অস্তিত্ব নাকি অনেকটা নেক্রোনমিকনের মত। আরব মুসলমানদের কাছে এই বই নাকি,‘শয়তানের পুঁথি’? মানে পঞ্চানন মঙ্গল? কিন্তু সেরকম তো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় না বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে! দেখা যায় এই কাব্য মোটেই অন্যান্য মঙ্গল কাব্যের মত গূঢ় জীবনদর্শন বা দেবস্তুতি নয়। এর ছন্দের মধ্যে লুকানো আছে অঙ্ক। গল্প এগিয়েছে এদিক ওদিক করে। কখনো ইতিহাস, কখনো বর্তমানকে ঘিরে। জালালুদ্দিনের সময়ের পঞ্চমুন্ডি গ্রামের ইতিহাসের ওপর ভর করে চলেছে পঞ্চানন মঙ্গল। তাতে যেমন এক বিয়োগান্তক মঙ্গলকাব্য আছে, তেমনি আছে এক অসম্ভব প্রতিভাবান বাঙালী কবিরাজের রচনায় গনিতের সাথে কাব্যের মেলবন্ধন। পড়লে চমৎকৃত হতে হয়। লুপ্ত এক মঙ্গলকাব্য ঘিরে এক অসাধারণ থ্রিলার”
পঞ্চাননমঙ্গল এর কাহিনীর অন্যতম আকর্ষণের দিক প্রাচীন ভারতের গণিত চর্চার মণিমুক্তোগুলিকে তুলে আনতে পারা। যে কৃতিত্ত্ব আমাদের বিজ্ঞানীদের পাওয়া উচিত ছিল, অনেক সময়েই তাঁরা তা পান নি। আর্যভট্ট বা ব্রহ্মগুপ্তদের আবিস্কারগুলি আরবীয় অনুবাদের হাত ধরে পশ্চিমী জগতে পৌঁছেছে। কিন্তু সে ইতিহাসের অনেকটাই আড়ালে ঢাকা। প্রীতম বসু আমাদের সেই ইতিহাস এখানে আখ্যানের ফাঁকে ফাঁকে জানিয়ে দিতে চান। আটশো শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় পণ্ডিতের হাত ধরে ভারতের সুপ্রাচীন গণিতবিদ্যা পৌঁছোয় বাগদাদের রাজসভায়,আরবিতে অনুবাদ করা হয় সেই পুঁথিগুলির। সেই সূত্রেই পরবর্তীকালে অল-খোয়ারিজমি ‘ভারতের সংখ্যা দিয়ে গণনাপদ্ধতি’ ব্যবহার করে অ্যালগরিদমএর জনক হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে পরিচিত হন (অল-খোয়ারিজম এর অপভ্রংশই আজকের অ্যালগরিদম) আর তারপর নানা আফগানী তুর্কি আরবী শাসক, যাদের অন্যতম বক্তিয়ার খিলজি - ভারতের গর্ব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তিন মাস ধরে পোড়ান হয় ভারতের মহামূল্যবান পুঁথিসমূহকে, যাতে কিনা ভারতের একান্ত নিজস্ব গণিতবিদ্যা আবিষ্কারের উজ্জ্বল ইতিহাস কালের গর্ভে চিরকালের মতো নিমজ্জিত হয়। আমরা জানতে পারি না অনেক আগেই ভারতে জানা হয়ে গিয়েছিল আলোর গতিবেগের পরিমাপ, 'পাই'-এর মান, অ্যালজেব্রা, ত্রিকোণমিতি, দশমিকের ব্যবহার, তথাকথিত ‘পিথাগোরাসের থিওরেম’ পিথাগোরাসের জন্মের দুশো বছর আগেই।
এই গণিত চর্চার ইতিহাস যেমন আমরা জানি না, ঠিক তেমনি আজকের বাঙালি সেভাবে জানেন ই না আমাদের এই বাংলা নৌ নির্মাণ থেকে কামানের ব্যবহারে কত দক্ষ ছিল। চিনের নৌ নির্মাতারা যেমন আসতেন এই দেশে, তেমনি এদেশের যুদ্ধে প্রথম কামান ব্যবহারের গৌরব যিনি পেয়ে থাকেন সেই বাবর স্বয়ং কীভাবে তাঁর আত্মজীবনীতে বাঙালির কামান চালানোর দক্ষতার প্রশংসা করে গেছেন।
এই লেখা শুধু আমাদের অতীতের জন্য গর্বকেই জাগিয়ে তুলতে চায় না। সেই অতীত কীভাবে আরবীয় তুর্কী মুসলমান শক্তির হাতে ধ্বংস হল সেই মনস্তাপও তৈরি করে। এই জন্যেই এই লেখা নিয়ে সতর্ক হবার অবকাশ আছে। যাতে ইতিহাসের বদলার রাজনীতি, যা আমরা রাম মন্দির আন্দোলনে বাবরি ভাঙার ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি, তা এ থেকে জন্ম নিতে না পারে। সম্ভবত লেখকও এই বিপদটি সম্বন্ধে সতর্ক। তাই আমরা দেখি পঞ্চানন এর মন্দিরটি একদিনের মধ্যে অনেক সহকারী জুটিয়ে তৈরি করে দেন যে কুশলী কারিগর, তিনিও এক মুসলমান। এবং তার পূর্বপুরুষদের মন্দির ভাঙার প্রায়শ্চিত্ত যেন তিনি এই কাজের মধ্যে দিয়ে করে যান। পারিশ্রমিক গ্রহণ করেও তা ফিরিয়ে দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের নজির রাখেন।
বাঙালির অতীত মনন চর্চার ইতিহাস এখানে আছে, আছে বিদেশী শক্তির হাতে পর্যদুস্ত হয়ে সেই ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলার মনস্তাপও। আর রয়েছে নিজের শিকড়ে ফেরার টান। মন্দিরের চাতালে কবিগান, ঝুমুর গান, আখড়ার সংস্কৃতি ফিরে পাওয়ার আগ্রহ। বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এমন নান্দনিক উপস্থাপণা বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে কমই হয়েছে।

No comments: