চৌথুপীর চর্যাপদ প্রীতম বসুর দ্বিতীয় আখ্যান, যেখানে
তিনি পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল এর পরে আরেকবার বাঙালি জীবনের এক উতরোল সময়ক্ষণের
পুনঃনির্মাণে প্রয়াসী হলেন। পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের মতো এই আখ্যানেও প্রাচীন
সাহিত্যকীর্তি ও পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী আবিস্কারের সূত্রে একটি থ্রিলারের জন্ম দেন
কথক। এখানেও পঞ্চাননমঙ্গলের মতোই দুটি ভিন্ন সময়ের আখ্যান দ্বিবেণীবদ্ধ হয়ে এগিয়ে
চলে। পঞ্চাননমঙ্গলে যদি থেকে থাকে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষাভঙ্গীতে লেখা
কাব্য অংশ তো এখানে রয়েছে আরো প্রাচীন চর্যাপদের আদলের পদাবলী। পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির বাইরের আদলটিই যেমন শুধু কাব্যের আর ভেতরে রয়েছে
গণিতের নানা সূত্র, তেমনি এখানেও পদাবলিগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞান,নানা ওষধি ও ভেষজ শাস্ত্রের আকর। চৌথুপীর চর্যাপদ
লেখকের পরবর্তী উপন্যাস হলেও এর সময়কাল পঞ্চাননমঙ্গলের চেয়ে অন্তত দুশো বছরের
পুরনো। পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির সময়কাল পঞ্চদশ শতকের প্রথম ভাগ আর
চৌথুপীর চর্যাপদের ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়া, যখন বাংলায় তুর্কি আক্রমণ সদ্য শুরু
হয়েছে। বস্তুতপক্ষে তুর্কি আক্রমণে বিধ্বস্ত বাংলার ছবিটা দুটি আখ্যানেই আমরা পাই,
পাই সেই বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের হাত থেকে নিজের অতীত ইতিহাস জ্ঞান
বিজ্ঞানকে রক্ষার মরীয়া চেষ্টা।
প্রীতম বসুর দুটি আখ্যানই ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের
প্রয়োজনে যথেষ্ট গবেষণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। আবার এই গবেষণাই কোথাও কোথাও লেখককে
প্রলুব্ধও করেছে আখ্যানের গতিকে থামিয়ে তথ্য পরিবেশনে। বিশেষ করে চৌথুপীর
চর্যাপদের সাম্প্রতিক সময়ের আখ্যান অংশটির চরিত্র পাত্ররা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে
দাঁড়িয়ে চরম সঙ্কটজনক কিছু মুহূর্তেও যেভাবে অতীতের তথ্য উদগীরণ করতে থাকে, তার
আখ্যানগত বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠেছে এই দুটি
আখ্যানেই ইসলামোফোবিয়ার উপাদান আছে কীনা তা নিয়ে। আমরা পরে এই প্রশ্নটির মুখোমুখি
হব। তার আগে বলা দরকার চৌথুপীর চর্যাপদের বিশিষ্টতার জায়গাগুলি নিয়ে।
এই আখ্যানের সমকাললগ্ন যোজনগন্ধা কেন্দ্রিক আখ্যানটি
মাঝে মাঝেই গতি হারিয়েছে, পট পরিবেশের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তিও আমরা পেয়েছি
মামাজীর কাছে পাত্রপাত্রীদের বন্দীদশার দীর্ঘ পর্বটিতে। এই দুর্বলতার উল্টোদিকেই
রয়েছে গন্ধকালী কেন্দ্রিক প্রাচীন আখ্যানটি, যেখানে প্রীতম বৌদ্ধ পরিবেশের অসামান্য
পুনঃনির্মাণ ঘটান। শুধু যে প্রাচীন অংশটির আখ্যানবিন্যাস এখানে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে
তাই নয়, যুগের আবহটি ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও লেখক বিশেষ সাফল্য পেয়েছেন। আর অতি
অবশ্যই বলতে হয় গন্ধকালী চরিত্রনির্মাণ প্রসঙ্গে। এক গ্রাম্য বালিকা, যার এমনকী
পাঠশালায় যাবার অনুমতি পর্যন্ত মেলে নি এক সময়, সে কী করে সমকালীন
জ্যোতির্বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বিদুষী হয়ে উঠল, হয়ে উঠল ভেষজ বিষয়েও পারঙ্গম, তার
নাটকীয় আখ্যান এখানে আছে। কিন্তু গন্ধকালীর বিদুষী থেরী সঞ্জীবনীতে রূপান্তরণের
মধ্যে দিয়েই তার জীবনবৃত্ত শেষ হয়ে যায় নি। তিব্বতী রাজকুমার খু স্তোন এর সাহচর্যে
তার চাপা থাকা নারীত্বের দিকগুলি অগ্নিস্ফুলঙ্গের মতো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। থেরীর
জীবন থেকে সে আবার সরে আসে গন্ধকালীর সাংসারিক নাম পরিচয়ে।
সমকাললগ্ন আখ্যানটির কেন্দ্রীয় চরিত্র যোজনগন্ধা পুরাতত্ত্ব
বিশেষজ্ঞ, ‘সিদ্ধমাতৃকা : সিক্রেট কোডস অব ট্যানট্রিকস’ নামের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক
বিখ্যাত এক বইয়ের লেখিকা। তাঁর বাবা ডক্টর বুধাদিত্য
চ্যাটার্জিও ছিলেন পুরাতত্ত্বের পণ্ডিত ও আবিষ্কারক। পুরাতাত্ত্বিক আবিস্কারের নেশাতেই একসময় তাঁর প্রাণ যায়। যেখানে তিনি মারা
গিয়েছিলেন সেই চৌথুপী আরেকবার উঠে আসে খবরে। একটি মূর্তি উদ্ধার ও খুনের সূত্রে।
যোজনগন্ধা ক্যান্সার আক্রান্ত, তার অপারেশনের দিন নির্ধারিত হয়ে আছে। তবু এই বিশেষ
জায়গাটির আকর্ষণে সে দুদিনের জন্য প্লেনে করে পাড়ি দেয় উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে।
ঘটনাচক্রে এই দুদিন বেড়ে যায় দু সপ্তাহে। যোজনগন্ধা ও অন্যান্যরা মামাজী নামের এক ব্ল্যাকমেলারের হাতে বন্দী হয়। এই ঘটনাবহুল
সফরকালেই হঠাৎ পাওয়া গন্ধকালীর লেখা এক চর্যাপদের পুঁথি হাতে আসে যোজনগন্ধার। সে
এর পাঠে নিবিষ্ট হয়। ঘটনার নানা আবর্তে তার সহপাঠক হিসেবে আসেন তিব্বতী এক লামা,
লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল, যিনি ভেষজ বিদ্যায় ও সিদ্ধম লিপি তথা বৌদ্ধ শাস্ত্রে পারঙ্গম।
উভয়ে মিলে গন্ধকালীর ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় লেখা বৌদ্ধ গান ও দোহা’গুলি
আজকের ভাষায় পড়ে ফেলেন। বস্তুত গন্ধকালী কাহিনিটিই এই উপন্যাসের মূল মর্মবস্তু।
গন্ধকালী ছিলেন উত্তর বাংলার এক গ্রাম্য ধীবরের
কন্যা। বাল্যে তাকে ডাকাতেরা অপহরণ করেছিল, তাই সংসারের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে
সমাজ তাকে দূরে রেখেছিল। সেই সময়কালটা ছিল বাংলায় তুর্কি আক্রমণের প্রথম পর্ব।
ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাহিনী তখন একের পর এক মন্দির, বৌদ্ধ
বিহার ধ্বংস করছে, সেখানকার পুঁথিপত্র জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্মমভাবে হত্যা করছে
সেখানকার মানুষকে, তাদের ওপর জোরজুলুম করে চাপিয়ে দিচ্ছে নিজেদের ধর্ম। এই সময়েই
গন্ধকালী নদীর বুক থেকে উদ্ধার করেন বৌদ্ধ আচার্য শ্রীধর পণ্ডিতকে। জ্যোতিষ
শাস্ত্রের দিকপাল পণ্ডিত আচার্য শ্রীধর ছিলেন নালন্দা, বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রাক্তন
অধ্যাপক, শিলাদিত্য সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষ। শিলাদিত্য
সঙ্ঘারাম তুর্কি আক্রমণে ধ্বংসের সময় সেখান থেকে কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে তিনি পালিয়ে
আসেন। মৃতপ্রায় শ্রীধর আচার্যকে সুস্থ করে তোলেন গন্ধকালী ও তার বাবা চন্দর মাঝি। সেখানেই ছেলেদের পড়ানোর কাজে যুক্ত হন শ্রীধর। এমন
পণ্ডিতকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে গ্রামবাসীরাও খুশি হয়। কিন্তু বিবাদ বাঁধে গন্ধকালী
বিদ্যাশিক্ষায় যুক্ত হলে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে শ্রীধর পণ্ডিতের শাস্ত্রের
নিদান ভিত্তিক যুক্তিমালাও সমাজের কিছু মুরুব্বীকে আশ্বস্ত করে নি। লোপামুদ্রা,
বিশ্ববারা, সিকতা, নিভাবরি, ঘোষা, মৈত্রেয়ী, গার্গি প্রমুখ প্রায় কুড়িজন বিদুষী
মহিলার রচিত স্তোত্র যে ঋকবেদে আছে – এই তথ্যকেও তারা আমল দিতে প্রস্তুত হয় নি। পরিবেশ
পরিস্থিতির জটিলতা শেষপর্যন্ত গন্ধকালীকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে। কিন্তু তার
মধ্যেই শ্রীধর পণ্ডিতের শিক্ষা এবং নিজের ধীশক্তির সমন্বয় তাকে একজন পারঙ্গম
জ্যোতির্বিদ করে তুলেছে অতি অল্প বয়সেই। ঘটনার বিচিত্র আবর্ত পেরিয়ে শেষমেষ
গন্ধকালী নানা বাধা অতিক্রম করে এসে হাজির হয় চৌথুপী বিহারে, যা ছোট হলেও
জ্ঞানচর্চার এক প্রশংসনীয় কেন্দ্র ছিল। বিশেষ করে এর জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগটি ছিল
ফলিত ও তাত্ত্বিক চর্চার এক উন্নত প্রতিষ্ঠান। সে যুগের দুই শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ
শান্তভদ্র ও তিব্বতী আচার্য তোন পা ছিলেন এর দুই স্তম্ভ। আর শীর্ষে ছিলেন সদ্য
তরুণী গন্ধকালী, যিনি ততদিনে রূপান্তরিত হয়েছেন থেরী সঞ্জীবনীতে।
অতীতের এই মূল কাহিনীটির সঙ্গে এসে মিশেছে একটি ছোট
তিব্বতী উপকাহিনীও। যেখানে আমরা দেখি তিব্বতের রাজা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। তিব্বতে
এর চিকিৎসা নেই, কিন্তু ভারতে আছে। কুষ্ঠের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছে রাজপুত্র
খু স্তোনেরও। হাজার হাজার তিব্বতবাসীও এতে আক্রান্ত। নিজের, পরিবারের ও দেশের রোগ মুক্তির
উপায় খুঁজতে বিঘ্নসঙ্কুল পথ পেরিয়ে খু স্তোন হাজির হন ভারতে। পথে তার সমস্ত
সঙ্গীরাই মারা যান শত্রু আক্রমণে। ভারতে আসার পথে খবর পান তার কাকা তার বাবাকে
বন্দী করে নিজেই সিংহাসন দখল করেছেন। ভারতে এসে খু স্তোন শেষমেষ এসে পৌঁছন চৌথুপী
বিহারে, সেখানেই তার সাথে সাক্ষাৎ হয় থেরী সঞ্জীবনীর।
চৌথুপীও তখন মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। যে
কোনও মুহূর্তে তুর্কীরা এসে ধ্বংস করতে পারে বিহার ও তার পুঁথিশালা যেখানে রয়েছে
পদ্মসম্ভব, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, প্রজ্ঞাকরমিতি, পণ্ডিত নারো পা, স্থবির বোধিভদ্র,
শ্রীজ্ঞান মিত্রের মতো পন্ডিতদের লেখা বহু মহামূল্যবান পুঁথি। আশেপাশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া
বিহারগুলি থেকেও - যার অন্যতম বিক্রমশীল মহাবিহার - বেশ কয়েক হাজার পুঁথি তখন গোপনে এসে পৌঁছেছে চৌথুপীতে। বাংলা তথা ভারতের জ্ঞানসাধনার সেই অমূল্য সম্পদগুলিকেও তুর্কী ধ্বংসলীলার হাত থেকে
বাঁচানো নিয়ে সবাই চিন্তিত। বেশ কিছু পুঁথি চৌথুপীর তিব্বতী
পণ্ডিত তোন পার সহায়তায় তিব্বতে পাঠানো হয়েছে। বাকী আরো কয়েক হাজার পুঁথিকে এক
রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় যাত্রার মধ্যে দিয়ে শত্রুর শ্যেন দৃষ্টি ও মাথার ওপর উদ্যত
মৃত্যুর করাল ছায়া অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত তিব্বতে নিয়ে যান খু স্তোন ও থেরী
সঞ্জীবনী। অবশ্য এই যাত্রায় থেরী সঞ্জীবনীর চীবর ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন পূর্ণ
যৌবনা নারী গন্ধকালী। যুবরাজ খু স্তোনের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার প্রেক্ষাপট
রচিত হয়েছে এই দুর্গম নাটকীয় অভিযাত্রার সময়। তিব্বতে গিয়ে কাকার হাত থেকে সিংহাসন
মুক্ত করেছেন স্তোন পা, পিতার মৃত্যুর পর রাজা হয়েছেন। আর রণ কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার
মিশেলে পরাজিত করেছেন আক্রমণকারী পরাক্রান্ত তুর্কি বাহিনীকে।
যেহেতু এই উপন্যাসে তুর্কী আক্রমণের ভয়াবহতা, তাদের
বিধর্মীদের আক্রমণ, মঠ মন্দির ধ্বংস ও পুঁথি পোড়ানো ও হত্যালীলার বিস্তারিত বিবরণ
রয়েছে,রয়েছে সে সম্পর্কে এই স্বাভাবিক বীতরাগের আবহও – তাই কেউ কেউ এই আখ্যান
প্রসঙ্গে তুলেছেন ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ। বিশেষ করে এমন এক সময়ে এই আখ্যানটি পাঠকের
সামনে হাজির হয়েছে যখন ইসলামোফোবিয়া দেশ দুনিয়া জুড়ে যথেষ্ট ব্যাপ্ত ও চর্চিত একটা
বিষয়।
এই প্রসঙ্গে এটাই বলার যে এই সময়ের ইতিহাসকে আজকের
সমাজ রাজনীতিতে টেনে যদি একটি ধর্মর মানুষজনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করার চেষ্টা
করা হয় সমাজ বাস্তবতার দৈনন্দিনতায়, ইতিহাসের প্রতিশোধ নেবার ভাষ্যটি উদগ্র হয়ে
ওঠে, যেমনটা কখনো কখনো হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় তাকে ইসলামোফোবিক বলে আখ্যাত করা
সঙ্গত। কিন্তু প্রীতম বসু তুর্কী আক্রমণের সময়ের বাস্তবতার কোনও প্রতিস্পর্ধাকে
সমকালে হাজির করার বয়ান হাজির করেন না, তার ইঙ্গিৎ মাত্রও দেন না। প্রীতম তুর্কী আক্রমণের
প্রেক্ষাপটে তার এই আখ্যান নির্মাণ করেছেন এবং সেই সময়ের ইতিহাস স্বীকৃত আবহটিই তিনি
নির্মাণ করেছেন। মীনহাজ এর তবাকাৎ ই নাসিরি সহ সেই সময়ের স্বীকৃত ইতিহাসের
উপাদানগুলি থেকে প্রীতম সরে যান নি এবং সেই নিরিখে তার এই আখ্যানের প্রতি ইসলামোফোবিয়ার
অভিযোগ তোলা বাতুলতা।
অবশ্য অতীত গৌরব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অর্জনের কথাগুলি বলতে
গিয়ে প্রীতম অতিরেক করেছেন, এই অভিযোগ অনেকদূর পর্যন্ত
তথ্য সমর্থিত। মহাভারতের কাল গ্রহ নক্ষত্রের গ্রহণের বিস্তারিত বিবরণ
সূত্রে মেপে ফেলার অধ্যায়টিই হোক বা সে যুগে আলোর গতির পরিমাপ জানা থাকার প্রসঙ্গই
হোক – প্রীতম কল্পনাকে বাস্তব তথ্যের চেয়ে
অনেক বেশি দূরে কোথাও কোথাও নিয়ে গিয়েছেন। এটি আখ্যানমাত্র,ইতিহাস নয়,তাই আখ্যানকারের
এমত কিছু স্বাধীনতা থেকেও যায় একথা যারা বলতে চান - তাদের বলা যেতে পারে এইসব অতিরেক বিপুল গবেষণার ভিত্তিতে আখ্যান নির্মাণের যে বিশিষ্ট
অর্জন,তার দিকেই কিছু প্রশ্ন তোলার সুযোগ
করে দেয়।
কিছু অতিরেক সত্ত্বেও গন্ধকালী আখ্যান নির্মাণ যে
উচ্চতায় এখানে পৌঁছল, সমকালীন যোজনগন্ধা আখ্যানটি তার বিপরীতে কেন এত নিষ্প্রাণ ও
স্থবির হয়ে রইলো তা পাঠককে ভাবাবেই। এখানে ঘটনা পরম্পরার অতি নাটকীয়তাই শুধু যে
বিশ্বাসের বাস্তবতাকে আঘাত করে তাই নয়, সঙ্কট মুহূর্তে চরিত্র পাত্রদের আচার আচরণ
ও দীর্ঘ দীর্ঘ বচনগুলিও অবিশ্বাস্য মনে হয়। বিশেষত আখ্যান কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর
যখন ব্ল্যাকমেলার মামাজীর অধীনে যোজনগন্ধা ও হাবিলদারের দীর্ঘ বন্দিদশা শুরু হয়,
তখন থেকে আখ্যানও তার গতি হারিয়ে একই জায়গায় প্রায়শ পুনরাবৃত্ত ফলত ক্লান্তিকর হতে
থাকে। যোজনগন্ধার আচার আচরণ সংগতিপূর্ণ হচ্ছে না এটা অনুভব করেই কি লেখক একদম শেষে
ক্যান্সারের পাশাপাশি ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার নামক তার এক মানসিক রোগের
কথা পাঠককে জানিয়ে দেন ?
অতিরেকগুলি বাদ দিয়েও প্রীতম যেভাবে বাংলা তথা ভারতের
জ্ঞান বিজ্ঞান জগতের বিশিষ্ট অর্জনগুলিকে একের পর এক তুলে আনেন, তার ধারাবাহিক
চর্চার কথা বলেন – তা আমাদের জাতিগত গৌরবকে পুনঃনির্মাণের এক জরুরী চেষ্টা। আমাদের
গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ব্যুৎপত্তিই হোক বা ভেষজ চিকিৎসাশাস্ত্রের
বিষ্ময়কর বিকাশই হোক, অনেক পরিশ্রমসাধ্য গবেষণার মধ্যে দিয়ে প্রীতম তার স্বাদু
পরিবেশন করেছেন এখানে। অনেক প্রচলিত ধারণাকে উলটে পালটে দিয়েছেন। অনেক নতুন তথ্যের
সমাবেশ ঘটিয়ে আমাদের অতীতের প্রতি বিষ্ময়মুগ্ধ ভালোবাসার বোধ জাগিয়ে তুলেছেন, যা
চৌথপীর চর্যাপদের অন্যতম অবদান।
ভারতীয় ভেষজের আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে এবং তার
সন্ধানে বে আইনি কারবারের চেষ্টা আমরা সংবাদপত্রের পাতায় মাঝেমাঝেই দেখতে পাই।
প্রীতম আমাদের জানিয়েছেন কিড়াজড়ি নামে লোকমুখে জনপ্রিয় এক ঘাসের কথা, যার রয়েছে
যৌবন প্রদীপ্ত করার অনবদ্য শক্তি। জানিয়েছেন ডাকিনী
ব্রহ্মকালির বইয়ের সূত্রে এ সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘকালীন চেনাজানার কথা। ডাকিনী
শব্দের বর্তমান লোক প্রচলিত অর্থের সাথে প্রকৃত অর্থের পার্থক্যটি ধরিয়ে দিয়ে
প্রীতম জানিয়েছেন বিদ্যার সঙ্গে শব্দটির সংযোগের কথা, ডাক ও খনার বচন কথাটির মধ্যে
যা ধরা আছে। গন্ধকালীর শিক্ষাসূত্রে এখানে এসেছে ভারতের জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার
মহান ঐতিহ্যের কথা। আর্যভটের আর্যভটীয়, ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত ছাড়াও
এসেছে পরাশর সিদ্ধান্ত, অত্রি সিদ্ধান্ত, গর্গ সিদ্ধান্ত, সূর্য সিদ্ধান্ত, মরীচি
সিদ্ধান্ত, অঙ্গিরস সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বইগুলির কথা।
এসেছে ফলিত জ্যোতিবির্জ্ঞান চর্চায় সেকালের মানমন্দিরে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রের
প্রসঙ্গ, যার মধ্যে ছিল জলঘড়ি, শঙ্কু, ফলক যন্ত্র, কপাল যন্ত্র, দোলন যন্ত্র
ইত্যাদি।
বিষ এবং ওষধি সম্পর্কে ভারতীয় ভেষজবিদ ও চিকিৎসকদের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডারের কিছু
কিছু নিদর্শন গন্ধকালীর বইয়ের সূত্রে এখানে হাজির করেছেন আখ্যানকার। সেই হারিয়ে
যাওয়া জ্ঞান পুনরুদ্ধারে বিশ্বের তাবড় তাবড় ওষুধ কোম্পানির আগ্রহ ও কোটি কোটি টাকা
বিনিয়োগের কথাও জানিয়েছেন। চাণক্য বর্ণিত মারাত্মক বিষ বা ক্ষুদাহরণকারী ওষুধের
কথা এখানে এসেছে। লামা লবসাঙ
চ্যোগিয়্যাল জানিয়েছে মৌর্যযুগের সেনাদের একপ্রকার ক্ষুধাদমনকারী ওষুধ দেওয়া হত,
যা খেয়ে পনেরোদিন বা এক মাস সেনারা খাদ্যাভাবেও যুদ্ধ করতে পারত। নারীদের ঋতুবন্ধ
করার ওষুধও সেকালে জানা ছিল বলে লামার মুখ থেকে শুনি আমরা, শুনি চাণক্য বর্ণিত
সেযুগের একধরনের কেমিক্যাল ওয়েপেনের কথা।
আমাদের অতীতের জ্ঞানবিজ্ঞানের দিকে নজর ফেরানো, নিজের
ইতিহাস ঐতিহ্য শিকড়কে শ্রদ্ধা করতে ভালোবাসতে শেখা প্রীতম বসুর প্রথম উপন্যাস
পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্য চৌথুপীর চর্যাপদেও
বর্তমান। এই ধারায় বাংলায় সাম্প্রতিক কালে আরো উল্লেখযোগ্য লেখালেখি শুরু হয়েছে,
তা পাঠকদের কাছে বিপুল সমাদরও পাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের
একটি ইতিবাচক দিক।
No comments:
Post a Comment