Friday, November 16, 2018

নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা


একাদশ শতকের প্রথমদিকে অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধধর্ম ও সংশ্লিষ্ট জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে বাংলা থেকে তিব্বতে গিয়েছিলেন সেখানকার রাজার বিশেষ অনুরোধে অতীশ তিব্বত এবং সুমাত্রা (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) সহ পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃর্ণ ভূভাগে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের বিস্তারে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন এবং এক মহামানবে পরিণত হন তাঁকে বিশেষভাবে জানাবোঝার এক আগ্রহ তৈরি হয় সেখানকার বিদ্বৎসমাজে তাঁদের কেউ কেউ চলে আসেন অতীশের দেশে, যে দেশ তাঁদের পরম পুজ্য গৌতম বুদ্ধেরও অতীশের তিব্বত যাত্রার দুশো বছর পরে অতীশকে নিবিড়ভাবে জানাবোঝার তাগিদে এদেশে আসেন তিব্বতী লামা চাগ্লোচাবা তিনি যখন নালন্দায় আসেন সেই মুহূর্তে নালন্দা জ্বলছে তুর্কি আক্রমণে ইখতিয়ার উদ্দীন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর সেই আক্রমণের ক্ষণেই নালন্দায় তার সাথে দেখা হয় বৃদ্ধ ভিক্ষু আর্য শ্রীভদ্রর শ্রীভদ্র লোচাবাকে পালিয়ে যেতে বলেন দূরে, আর উপহার দেন অতীশের ব্যবহৃত সামগ্রী ও লিখিত পুঁথি সমেত এক কাষ্ঠপেটিকা
এর আটশো বছর পর আমাদের কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে এই কাষ্টপেটিকাটি পুনরাবিষ্কৃত হচ্ছে এমনই এক কাহিনীর সামনে আমাদের দাঁড় করান নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটার আখ্যানকার সন্মাত্রনন্দ বাংলাদেশের বিক্রমপুর এলাকায় এই কাষ্ঠপেটিকা পুনরাবিষ্কৃত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেটি বিস্তারিত গবেষণার জন্য পাঠিয়ে দেয় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে সেখানকার আধিকারিক শুদ্ধশীল ভট্টাচার্য পুরাতত্ত্ববিদ সম্যক ঘোষকে এটা গবেষণার জন্য দেন তা নিয়েই আলোচনা শুরু হয় সম্যক ও তার প্রাক্তন ও বর্তমান দুই গবেষক ছাত্রছাত্রী শ্রীপর্ণা ও অমিতায়ুধের মধ্যে বস্তুতপক্ষে এই ত্রিবেণীবদ্ধ আখ্যানটির বর্তমান সংলগ্ন কাহিনীটির কেন্দ্রে রয়েছে পুরাতত্ত্ব গবেষক অমিতায়ুধ ত্রয়োদশ শতাব্দীর কাহিনীর কেন্দ্রে তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষু চাগ্লোচাবা এবং এই দুই কাহিনীর দুই কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব খুঁজে চলেছেন প্রথম কাহিনীর নায়ক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের জীবন ও শিক্ষাকে, যিনি একাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক মহাদেশজোড়া প্রভাবসঞ্চারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিরায়ত স্থান পেয়েছেন ইতিহাসে
এ কাহিনীর প্রথমদিকে অবশ্য শ্রীজ্ঞান অতীশ চন্দ্রগর্ভ নামেও উল্লেখিত হয়েছেন এসেছে রাজপুত্র হিসেবে দেখা শ্রেণি বর্ণে বিভক্ত সমাজজীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে তার বেদনাবহ বীতরাগের কথা এসেছে এক জটিল সম্পর্কের প্রসঙ্গ, যার বেদনাবহ পরিণতি তার জীবনপথকে অনেক নতুন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছিল রাজকুমার চন্দ্রগর্ভকে ভালোবেসেছিল কুন্তলা বলে এক কিশোরী সেজন্য অনেক সামাজিক কলঙ্কও জুটেছিল তার প্রথম তারুণ্যেই নিজেকে যে দৌবারিকের স্থানে বসিয়ে সমাজলাঞ্ছিত মানুষের যাতনাকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন চন্দ্রগর্ভ, এই কুন্তলা ছিল তারই কন্যা সেই নিরিখে কুন্তলা চন্দ্রগর্ভের চোখেও হয়ে উঠেছিল কন্যাপ্রতিম তাদের কৈশোরের অনায়াস বিনিময়ে পরস্পরকে দেখার চোখ ছিল আলাদা দীর্ঘ ব্যবধানের পর রাহুলগুপ্তের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করে যখন ফেরে চন্দ্রগর্ভ, তখনই এই ভিন্ন দৃষ্টিকোণের কথা তার থেকে জানতে পারে কুন্তলা বেদনার প্রাগাঢ়তায় আত্মহনন করে সে চন্দ্রগর্ভ কুন্তলার আত্মহনন পরবর্তী পর্বে যখন বিমর্ষ, তখনই বারবার তার স্বপ্নে দেখা দেন গৌতম বুদ্ধ, এক মহাশ্রমণের বেশে অবশেষে রাহুলগুপ্তের একদা তান্ত্রিক শিষ্য চন্দ্রগর্ভ পারিবারিক তান্ত্রিক ধর্ম পরিত্যাগ করে চলে আসেন ওদন্তপুরী মহাবিহারে সেখানেই আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে তিনি শ্রামণ্যে দীক্ষিত হন তমসাচ্ছন্ন ধরিত্রীকে অজ্ঞাননিদ্রা হতে প্রতিপ্রবুদ্ধ করার ভার অর্পণ করে আচার্য শীলরক্ষিত বলেন এই শিষ্য তা পারবেন, কারণ –‘চিরজাগ্রত জ্ঞানদীপ তোমারই হৃদয়কন্দরে সতত দেদীপ্যমান! আজ থেকে তোমার নাম দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
সমকাললগ্ন কাহিনীটিকে কোলকাতার কসমোপলিটন আবহাওয়া আর বাংলাদেশের মুনশিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রামের বিপ্রতীপ পরিবেশে ভাগ করে দেন আখ্যানকার। কোলকাতার গবেষক অমিতায়ুধ বর্ধমানের গ্রাম্য পরিবেশেই বড় হয়েছে, তাই ওপার বাংলার গ্রামের মধ্যে সে সহজেই খুঁজে পায় তার ছেলেবেলার কিছু নস্টালজিয়া। চানঘরের জমানো জলের চেয়ে সবুজ পানাপুকুরে অবগাহনেই তাই তার বেশি উৎসাহ। গ্রামীণ শিক্ষকের অতিথি আপ্যায়ণের আয়োজনের আন্তরিকতা ও বিপুল খাদ্যতালিকাও আমাদের সামনে হাজির থাকে। কাঁসার থালায় ধোঁয়া ওঠা সরু চালের ভাত, ছোট একটি কাচের বাটিতে গন্ধলেবু, লঙ্কা, লবণ আর সরু সরু করে কাটা পেঁয়াজ। আর একটি কাঁসার বাটিতে ঘন মুসুরির ডাল। তারপর ফুলকাটা কাঁসার বাটি পরপর আসতেই লাগল। সুক্তুনি, আলুভাজা, পাটশাক ভাজা, ডাঁটাশাক, আলু বেগুনের চচ্চড়ি, কলাপাতায় মোড়া ইলিশের পাতুরি, টাটকা রুই মাছে ঝোল, মোরগের কালিয়া, আমসির টক, আবার ছোটো কাঁসার বাটিতে এক অপূর্ব আস্বাদের চাটনি... খাওয়ার শেষপাতে এল পায়েস, দই, মিষ্টিআবু তাহেরের পাশাপাশি সাদর অভ্যর্থণা জোটে বনেদী বাড়ির বৃদ্ধ মোতালেব মিয়াঁর থেকেও। তিনি অমিয়ায়ুধকে প্রায় জোর করেই নিয়ে এসে আতিথ্য দেন তার বাড়িতে, শোনান অতীতের নানা গল্প। আবু তাহেরের বাড়িতেই অমিতায়ুধ দেখে পড়শি জাহ্নবীকে। সেই কিশোরীই আবহমান কালের কুন্তলা হয়ে তার সামনে ধরা দেয়, যে নানা রূপে ঘুরে ফিরে আসে অতীশের সময়ে, চাগ্‌ লোচাবার সময়ে বা সমকালে অমিতায়ুধ এর সামনে।
একাদশ শতকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সংশ্লিষ্ট আখ্যানটিতে স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধ দর্শন ও তার বিভিন্ন ধারার জটিল ছায়াপাত রয়েছে যা সাধারণ আখ্যান পাঠককে খানিক আবর্তে ফেলতে পারে। পাঠক যখন পড়েন, অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি, দুঃখ এই দ্বাদশ নিদান। একটি থাকলেই আরেকটি থাকবে। একটি চলে গেলেই, অপরটি নির্বাপিত হয়ে যাবে এই ধরনের অংশ বা এরপরে যখন আসে এগুলির ব্যাখ্যা তখন তিনি খানিকটা প্রতিহত হন বৈকি। বৌদ্ধ দর্শন বিষয়ে খুব দীক্ষিত পাঠক ছাড়া আখ্যানের এই ধরনের বেশ কিছু অংশ অনেকের কাছেই ছড়ানো উপলখণ্ড বলে মনে হতে পারে।
দশম একাদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে অতীশ যখন আচার্য শীলরক্ষিতের ছাত্র ওদন্তপুরী মহাবিহারে, তখন সেখানে বিভিন্ন বৌদ্ধশাখার মধ্যেকার বিতর্ক এবং তার মধ্যে থেকে প্রকৃত বুদ্ধবাণী বের করে আনা কতটা কঠিন ছিল, সেটা বেশ বিস্তারিতভাবেই এখানে এসেছে। এসেছে বিভিন্ন বৌদ্ধ ধারার মধ্যেকার ভেদাভেদ এর কথাও। - এ সঙ্ঘারাম, এ ভিক্ষুবিহারও কিন্তু সেই ভেদাভেদ হতে মুক্ত নয়। বৌদ্ধমত গণনাতীত শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি শাখার অনুগামীবৃন্দ একেক গোষ্ঠীভুক্ত। ইনি মহাসঙ্ঘিক, ইনি স্থবির, ইনি বাৎসীপুত্রীয়, ইনি সম্মিতিয়, উনি সর্বাস্তিবাদী। পরস্পর পরস্পরের সাথে বিবদমান। একেক সম্প্রদায়ের একেক বিনয়। মৃত্তিকাবিহারে অবস্থানকালে শীলরক্ষিতের নিকট বিনয়পিটকের পাঠ গ্রহণে দীপংকরকে সর্বাধিক শ্রম করতে হয়েছিল। ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বীগণের ভিন্ন ভিন্ন বিনয়পিটক, তার মধ্য হতে সর্ববাদিসম্মত নির্বিবাদ মত আবিষ্কার করা হয় দুর্ঘট, নয় অসম্ভবশাস্ত্ররচনাকালে একেক সম্প্রদায়ের একেক ভাষানিষ্ঠা! এ কি নিষ্ঠা, নাকি ভাষান্ধতা? ... মহাসঙ্খিকগণ প্রাকৃত ভাষায়, সর্বাস্তিবাদীগণ সংস্কৃত ভাষায়, স্থবিরবাদীগণ পৈশাচী ভাষায়, সম্মিতীয়গণ অপভ্রংশ বাঙময়ে শাস্ত্রচর্চা করেন। প্রকৃত বুদ্ধবচন কোনটি, বিভিন্ন মতাবলম্বীর মতভেদ কী বিষয়ে সেকথা জানবার জন্য দীপংকরকে বিভিন্ন ভাষা ও তার ব্যাকরণ স্বল্পকালের মধ্যে শিক্ষা করতে হয়েছে
অতীশ দীপংকরের আখ্যান বর্ণনার সূত্রে সমকালীন ভারত ইতিহাসের জটিল আবর্তকেও আখ্যানকার উপস্থিত করেছেন তখন বাংলার সিংহাসনে পালসম্রাট মহীপাল। গোটা ভারতে সেই সময়ে বিভিন্ন রাজারা পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও যুদ্ধে রত। পাল, কনৌজ (কান্যকুব্জ), চন্দেল, চেদী, পান্ড্য রাজাদের পারস্পরিক বিবাদ ও যুদ্ধবিগ্রহ অস্বীকার করে চলেছে পশ্চিম দিক থেকে গজনীর সুলতান মাহমুদের ক্রম আগ্রাসন, যা পরে এই সমস্ত অঞ্চলগুলির জন্যই ভয়াবহ হয়ে উঠবে।
এই আখ্যানে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন চরিত্রকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন আখ্যানকার। একুশ শতকের অমিতায়ুধ কখনো দাঁড়ায় ত্রয়োদশ শতকের চাগ্‌ লোচাবার সামনে, কখনো একাদশ শতকের দীপংকরের সামনে। কিন্তু দেখতে পায় না যেন। রাতের সব তারা দিনের আলোর গভীরে লুকিয়ে থাকলেও যেমন দেখা যায় না। এখানেই এক বিশেষ ইতিহাস দর্শনকে নিয়ে আসেন সন্মাত্রনন্দ। একই রকম অভিজ্ঞতা বা কথাবার্তার সামনে বিভিন্ন কালখন্ডকে দুলিয়ে দেওয়ার এক আশ্চর্য ন্যারেটিভ টেকনিককে ব্যবহার করে। এই ইতিহাস দর্শনের ব্যাখ্যাও মেলে আচার্য শীলরক্ষিতের জবানীতে, পালসাম্রাজ্যের যুবরাণী কাঞ্চনবর্ণার মনোবেদনা দূর করার সময় - অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যের ভিতর একই ধর্মসমূহ বা পদার্থনিচয় বর্তমান। কিন্তু ঐ সকল পদার্থনিচয়ের পারস্পরিক অবস্থান পরিবর্তিত হওয়ার কারণে এক প্রকারের সজ্জাকে বর্তমান,এক প্রকারের সজ্জাকে অতীত এবং আরো এক প্রকারের সজ্জা বা বিন্যাসকে ভবিষ্যৎ বলা হয়ে থাকে। বস্তুত অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সকলই এখানেই আছে। সকলই অস্তি। সর্বম অস্তিসর্বাস্তিবাদী বৌদ্ধদর্শনের এই ইতিহাসচেতনাই এই আখ্যানে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। তবে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নিরিখে এই বৌদ্ধ মতের সীমাবদ্ধতাও দীপংকরের শাণিত মেধার সূত্রে হাজির করেছেন আখ্যানকার, যেখানে তিনি তার গুরু শীলরক্ষিতের ব্যাখ্যা মানতে পারেন না। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে সব উপাদান একভাবে থাকলেও তা প্রাপ্ত নয় বিশেষ কালে দাঁড়ানো একজনের কাছে। শুধু অস্তির স্বান্ত্বনা প্রাপ্য অপ্রাপ্যের বাস্তব যন্ত্রণাকে ঢেকে ফেলতে পারে না। আর তাই জীবন জটিল ও দুঃখময়। এই বিষয়ে আরো অনুসন্ধানের জন্যই দীপঙ্করকে সুমাত্রা যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছিলেন আচার্য শীলরক্ষিত। কারণ আচার্য শান্তিদেবের পর এই মহাযান মত নিয়ে আর বেশি চর্চা এদেশে হয় নি। তিব্বতেই এই চর্চা প্রবহমান। এইভাবে ইতিহাসচেতনা ও দর্শনের নানা ধারা ও সেই সংক্রান্ত আলোচনা এ আখ্যানে বারবার ভিড় করেছে। বস্তুতপক্ষে বঙ্গদেশের অন্যতম প্রধান পণ্ডিতের জীবন অবলম্বনে রচিত আখ্যানে এই ধরণের দার্শনিক প্রসঙ্গ ও বিতর্ক অত্যন্ত স্বাভাবিক। সন্মাত্রনন্দের বিশেষ কৃতিত্ত্ব এই দার্শনিক প্রস্থান ও কাহিনীর সহজগতিকে তিনি পাশাপাশি প্রবহমান রাখতে পেরেছেন।
দীপঙ্করের জীবন কাহিনীর তিনটি অধ্যায়কে অবলম্বন করে এই আখ্যানের তিনটি বিভাগকে গড়ে তুলেছেন লেখক। প্রতিটি বিভাগকে এক একটি পীঠিকার নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। সুমাত্রা যাত্রার আগে পর্যন্ত আখ্যান নিয়ে প্রথম অধ্যায় যার নাম পূর্বপীঠিকা। পরবর্তী দক্ষিণপীঠিকার কাহিনী অতীশের সুমাত্রাবাস পর্বকে আশ্রয় করেছে। সুমাত্রায় এসে অতীশ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ধর্মরক্ষিতের কাছে। এইসময় তার সহপাঠী ছিলেন ভিক্ষু কমলরক্ষিত ও ভিক্ষু শান্তি। ধর্মকীর্তির অভিসময় অলঙ্কার নামক জটিল গ্রন্থের যথার্থ ও প্রাঞ্জল টীকা রচনা করে অতীশ তাঁর মেধার পরিচয় রাখেন। এখানেই ধর্মকীর্তি ও দীপঙ্করের আলোচনার সময় একঝাঁক পাখির ঘরে ঢুকে আটকে পড়া ও একটি পাখির পথ খুঁজে পেয়ে নিজে উড়ে যাওয়া ও অন্য এক পাখির পথ খুঁজে পেয়ে অন্যদের সেই পথ দেখানোর সূত্রে ধর্মকীর্তির মুখ দিয়ে হীনযান ও মহাযান পথের মুক্তির কথা এনেছেন লেখক। প্রথম যে পাখিটি কেবল নিজ মুক্তি বা নির্বাণের জন্য ব্যস্ত হল, তার পথকে থেরবাদী/হীনযান চিন্তার সঙ্গে ও দ্বিতীয় যে পাখিটি সকলকে নির্বাণের পথ দেখাতে চাইল, তার পথকে মহাযানের সাথে তুলনা করেন ধর্মকীর্তি। এই পশ্চিম পীঠিকাতে সুমাত্রায় শিক্ষালাভ শেষে দীপংকরের দেশে ফেরা এবং বোধগয়ার বজ্রাসন বিহারে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হবার অংশটিও সংযুক্ত। এই কালেই এক ভিন্ন দেশ তিব্বতের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেখানে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ে রাজার বেদনার কথা আমরা শুনি। তিব্বতে ধর্মকে বিকৃতি মুক্ত করতে অতীশকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার মনোবাসনাও প্রকাশ করেন রাজা।
আখ্যানের তৃতীয় তথা অন্তিম বিভাগটির নাম পশ্চিম পীঠিকা। এই অংশে দীপংকরের তিব্বত যাত্রার পটভূমি, যাত্রা ও তিব্বতের কর্মকাল বর্ণিত হয়েছে। পশ্চিম পীঠিকার শুরুতে আমরা দীপংকরকে বিক্রমশীল মহাবিহারের অধ্যাপক হিসেবে দেখি, যার খ্যাতি তখন আকাশস্পর্শী। পালরাজা মহীপাল বা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সকলেরই তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তবে মহীপালের পুত্র যুবরাজ নয়াপালের মধ্যে যৌবনের অহংকার কিছু প্রবল এবং তিনি যেভাবে মাঝেসাঝে বিক্রমশীল মহাবিহারের ওপর কিছু নির্দেশিকা জারি করেন, তা অতীশকে বিরক্ত করে। রাজগৃহে উৎসব উপস্থিত হলে তিনি মহাবিহারের পঠনপাঠনকে বন্ধ রেখে সমগ্র ভিক্ষুমণ্ডলীকে রাজাদেশে রাজগৃহে যেতে নির্দেশ দেন। এ নিয়ে নিবেদন করেও কোনও ফল হয় নি। বিহার পরিচালনায় আরো নানাভাবে যুবরাজ নয়াপাল অনুপ্রবেশ করেন, যেন বুঝিয়ে দিতে চান পালরাজারাই এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক। চেদির কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেবের ক্ষমতারূঢ় রাজপুত্র কর্ণ এইসময় পালরাজ্য আক্রমণ করায় সঙ্কট উপস্থিত হয়। অতীশ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা বাংলার পাল ও চেদি কলচুরিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মেটাতে ও বাইরের শত্রুর দিকে দৃষ্টি ফেরাতে সচেষ্ট হন। রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় অতীশের ভূমিকা ও বিক্রমশীল মহাবিহারের বিশিষ্টতা নয়াপালের মধ্যেও নতুন শ্রদ্ধার বীজ বপন করে। উনষাট বছর বয়সী প্রৌঢ় অধ্যাপক অতীশ, যাঁর খ্যাতি ও প্রতিপত্তি যখন এদেশে কিংবদন্তীতুল্য, তিনি কেন শেষপর্যন্ত তিব্বত যেতে সম্মত হলেন, সে কাহিনীও এই পীঠিকায় বর্ণিত হয়েছে। বীর্যসিংহ ও বিনয়ধর যারা তিব্বতের রাজার পক্ষ থেকে অতীশকে যাত্রার অনুরোধ জানাতে এসেছিল, তাদের কাছ থেকে তিব্বতের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সামাজিক সঙ্কটের কথা শোনেন অতীশ। বস্তুতপক্ষে তিব্বতের ধর্মীয় সঙ্কটের সঙ্গে রাজনৈতিক সঙ্কটের গভীর সম্পর্ক ছিল। তিব্বতের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। আর প্রবল প্রতাপশালী অমাত্যকুল ছিলেন তিব্বতের পোন বা বন ধর্মের পৃষ্ঠপোশক। উভয়েই জনসাধারণকে নিজ নিজ কর্তৃত্ব ও ধর্মাচরণের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাইতেন। পোন ধর্মের প্রভাবে ও সঠিক দিশার অভাবে তিব্বতের বৌদ্ধধর্মও অনেকাংশে বিকৃত হয়েছিল এবং জনগণকে পথ দেখাতে অসমর্থ হচ্ছিল। বস্তুত অতীশ ও বীর্যসিংহ বিনয়ধরের আলোচনাসূত্রে তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের রূপরেখাটি কয়েকটি বাক্যে হাজির করেছেন সন্মাত্রনন্দ। রাজা দেউচানের আমন্ত্রণে ভারত থেকে তিব্বতে প্রথমে যান আচার্য শান্তরক্ষিত, যিনি ছিলেন অতীশের মতোই চন্দ্রবংশজাত, তার পূর্বপুরুষ। পোন ধর্ম অনুসারীদের রোষ এবং অমাত্যদের চক্রান্তে শান্তরক্ষিতকে কিছুদিন পরে নেপালে নির্বাসিত হতে হয়। এরপর ভারত থেকে নেপালে যান গুরু পদ্মসম্ভব এবং তিব্বতে তিনি রিন্‌পোচে নামে পরিচিত ছিলেন। তন্ত্রমন্ত্রে দক্ষ পদ্মসম্ভবের ধর্মপ্রচার পোন ধর্মীদের প্রভাবকে স্থিমিত করে এবং নেপাল থেকে ফিরে আসেন শান্তরক্ষিত। এরপর শান্তরক্ষিতের শিষ্য কমলশীল সেখানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের কাজে ব্যাপৃত হন। এইসময় হোসাঙ নামে এক পোন ধর্মপ্রচারক সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কমলশীল তাকে বাকযুদ্ধে পরাজিত করেন। কিন্তু অমাত্যদের চক্রান্তে চারজন গুপ্তঘাতক কমলশীলকে হত্যা করে। ক্রমশ পদ্মসম্ভবের শিক্ষা কালের গতিতে ও নানা কুপ্রভাবে আবিল হয়ে পড়ে। ভারতাগত পণ্ডিতেরা তিব্বতে বিকৃত ধর্মচর্চায় ব্যস্ত থাকেন। নির্বিচার সুরাপান, পশুহত্যা, নারীসম্ভোগ, নরবলিতে ধর্ম অ সমাজ আবিল হয়ে পড়ে। এর থেকে মুক্তির পথ হিসেবেই তিব্বতের রাজা এশেওদ এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র চ্যাংচুবওদ অতীশকে তিব্বতে যাওয়ার অনুরোধ করেন। ভারতে অধ্যাপকের অনন্য সম্মান ও প্রতিষ্ঠাকে পেছনে ফেলে রেখে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের রক্ষা ও প্রসারের জন্য যেতে সম্মত হন প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো অতীশ।


Tuesday, October 02, 2018

এরিক হবসবম


বিশ শতকের অন্যতম খ্যাতনামা ঐতিহাসিক হিসেবে এরিক হবসবম গোটা দুনিয়ার সব মহলেই নন্দিত ছিলেন। এমনকী যারা মার্কসবাদের সমর্থক নন, তাঁরাও এই আনখশির মার্কসবাদী ঐতিহাসিকের অসামান্য অবদানকে মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন। হবসবম জন্মেছিলেন রুশ বিপ্লবের বছরে, ১৯১৭ সালে। তাঁর পরিবার তখন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে। হবসবমের জন্মের দু বছর পর তাঁরা প্রথমে চলে আসেন জার্মানীর ভিয়েনায়, অতঃপর বার্লিনে। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর হবসবম চলে আসেন ইংলণ্ডে এবং বাকী জীবন সেখানেই থাকেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পি এইচ ডি করেন, গবেষণার বিষয় ছিল ফেবিয়ান সমাজ। সারা জীবন ইতিহাসের অধ্যাপণার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী। ১৯৩৬ সালে তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং ১৯৯১ সালে পার্টি বিলুপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি এর সভ্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরীতে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর তাঁর বেশিরভাগ সহযোগী বন্ধু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করলেও তিনি পার্টির সাথেই যুক্ত থাকেন। পাশাপাশি সোভিয়েত রাশিয়ার স্খলনগুলি নিয়েও তিনি সে সময় সোচ্চার হন। হাঙ্গেরী এবং পোলাণ্ড এর বিদ্রোহকে সমর্থন করে তিনি একে বলেছিলেন, ‘আমলাতন্ত্র ও ছদ্ম কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবীদের বিক্ষোভ’।
প্রি ক্যাপিটালিস্ট ইকনমিক ফর্মেশন, ইণ্ডাস্ট্রি অ্যাণ্ড এম্পায়ার, রিভোলিউশনারিস, নেশনস অ্যাণ্ড ন্যশানিলজম, অন হিস্ট্রি বা সাম্প্রতিকালে লেখা ইন্টারেস্টিং টাইমস : এ টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরী লাইফ, গ্লোবাইলাইজেশন, ডেমোক্রেসি অ্যাণ্ড টেররিজম, হাউ টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড এর মতো বহু সাড়া জাগানো বইয়ের লেখক হলেও হবসবম সারা বিশ্বের মননশীল পাঠকের কাছে বিখ্যাত হয়ে আছেন চার পর্ব জুড়ে বিশ্লেষিত ইউরোপ তথা বিশ্বের আধুনিকতার ইতিহাসের অনবদ্য আখ্যানের জন্য।
এজ অব রিভোলিউশন (১৭৮৯-১৮৪৮), এজ অব ক্যাপিটাল (১৮৪৮-১৮৭৫), এজ অব এম্পায়ার (১৮৭৫-১৯১৪), এজ অব এক্সট্রিমস (১৯১৪-১৯৯১) সম্মিলিতভাবে আধুনিক সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্য হিসেবেই পরিগণিত হয়।
এজ অব রিভোলিউশন ফরাসী বিপ্লব ও ইংলণ্ডের শিল্প বিপ্লবের সূত্র ধরে আধুনিক ইউরোপের বহুস্তরিক নির্মাণপর্বের শুরুর দিনগুলোর অসামান্য ভাষ্য। আমরা স্মরণ করতে পারি বইয়ের প্রথম চমকপ্রদ বাক্যটি। ‘প্রথমেই নজরে পড়ে ১৭৮০ র দশকের পৃথিবী আমাদের আজকের পৃথিবীর তুলনায় একইসঙ্গে ছিল অনেক ছোট এবং অনেক বড়’। অতঃপর হবসবম আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে দেখান ভৌগলিক সীমা সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রেক্ষিতেই হোক বা লোকসংখ্যার নিরিখে, কেমন ছোট ছিল সে সময়ের পৃথিবী। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার তখনকার অপ্রতুল অবস্থা এই ছোট পৃথিবীকেই আজকের তুলনায় বড় করে দেখাত। হবসবম আমাদের দেখান শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে ইউরোপ তথা পৃথিবী কীভাবে নতুন নতুন ভৌগলিক ভূখণ্ডের সাথে নিবিড়ভাবে ক্রমশ পরিচিত হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে ধারণাগত আঞ্চলিক সীমা, আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব বিকাশ কীভাবে দূরকে করে তুলছে নিকট। শিল্প বিপ্লব এবং ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস, বিশ্বজোড়া তার তাৎপর্য, যা আগামী দিনগুলিকে সারা বিশ্বের জন্যই বদলে দেবে, তাঁর আসামান্য ভাষ্য রচনার পর হবসবম মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাস আলোচনা করেন। বিজ্ঞান ও সাহিত্য সংস্কৃতির অসামান্য বিকাশের পাশাপাশি গরীব শ্রমজীবী মানুষের একটি শ্রেণি হিসেবে কীভাবে তৈরি হয়ে উঠছে সে কথাও তোলেন হবসবম।
এজ অব ক্যাপিটাল বইটি ইউরোপীয় পুঁজিবাদের দুর্মর বিকাশ ও বিশ্বজোড়া তার প্রভাবের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে বারবার এসেছেন মার্কস, এসেছে তার ক্যাপিটাল ও অন্যান্য বইয়ের প্রসঙ্গ। হবসবম আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মার্কস এবং এঙ্গেলস যেমন বলেছিলেন, ‘ ইউরোপ একটা ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত’, তেমনি অন্য অনেকেও কেমন এরকমটাই বলছিলেন, যদিও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে। ১৮৪৮ এ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো লেখার বছরেই ফরাসী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিক আলেক্সি দ্য তকুইভিল সবার মনের ভাব প্রকাশ করছিলেন, ‘আমরা কি একটা আগ্নেগিরির ওপর দাঁড়িয়ে নেই? আমরা কি বুঝতে পারছি না জগৎটা কাঁপছে? বিপ্লবের হাওয়া বইছে, দিগন্তে দেখা যাচ্ছে ঝড়।’ পুঁজিবাদের বিকাশের পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ ও প্রতিস্পর্ধিতার গৌরবময় নানা প্রচেষ্টা, দ্বন্দ্বের ঝোড়ো হাওয়ার ইতিহাস এই বইটিতে হবসবম তুলে আনেন।
এজ অব এম্পায়ার বইটি শুরু হয় ১৮৫৭ র অর্থনৈতিক মন্দার পর্বটি দিয়ে। ইউরোপীয় পুঁজিবাদ দ্রুতই এই মন্দার দশা কাটিয়ে ওঠে, কিন্তু এই সময়েই আমেরিকান ও জার্মান অর্থনীতি ব্রিটিশ অর্থনীতিকে টেক্কা দিতে থাকে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ পণ্য চলাচলকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়, বাড়তে থাকে জীবনযাত্রার মান। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং দেশগুলির ভেতর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে অসাম্য পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর উপনিবেশ বাড়ানোর চেষ্টা। আপাত শান্তির পরিবেশে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলি অস্ত্রসম্ভার বাড়িয়ে যেতে থাকে। সময়ের মধ্যে নিহিত এইসব মৌলিক দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো এক তীব্র সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। লেনিনের মত অনেকেই মনে করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে। হবসবম স্বীকার করেন পুঁজিবাদ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। তবে তা পারলেও অষ্টাদশ শতকের শেষে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের উত্তরাধিকারজাত যে চরিত্র নিয়ে সে পথ চলা শুরু করেছিল তার সে চরিত্র বহুলাংশে বদলে গেছে। অনেক সমাজতান্ত্রিক দাবীকে নিজের মধ্যে অঙ্গীভূত করে ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ নামক এক ব্যবস্থার জন্ম দিতে সে বাধ্য হয়েছে।
এজ অব এক্সট্রিমস প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের সময়কাল থেকে ১৯৯১ এ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অবসানপর্ব পর্যন্ত সময়ের দলিল। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের দ্বন্দ্বর বিশ্বজনীন চেহারা ছাড়াও উপনিবেশগুলেতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে সমাজতন্ত্র, তার নির্মাণ, বিকাশ, জটিলতা, পুঁজিবাদের সাথে তার দ্বন্দ্ব ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন নিশ্চিতভাবেই এই বইয়ের মূল মেরুদণ্ড। হবসবম মনে করেছেন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্র শুরু থেকেই সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মৌলিক কিছু মতাদর্শের সাথে সংঘাতে উপনীত হয়। সমাজতন্ত্রের মধ্যে নিহিত গণতন্ত্রের প্রশ্নটিকে অনেক সময়েই অবহেলিত থাকতে হয়েছে। যুগস্লাভিয়া, আলবেনিয়া বা চিনের মত অনেক দেশের বিপ্লব শেষপর্যন্ত সোভিয়েত পরামর্শের চেয়ে ভিন্নপথে হেঁটেই অর্জিত হয়েছে। যেমন মাও স্টালিন নির্দেশিত পন্থাকে অতিক্রম করে নিজের দেশকালের অনুগ নিজস্ব পথ তৈরি করেছিলেন। কমিউনিস্টদের নিজস্ব কার্যক্রম সীমিত রেখে ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চেই সব প্রয়াস উন্মুক্ত করার কমিন্টার্নপ্রেরিত নির্দেশিকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনে অনেক সময়েই ভালো ফল দেয় নি।
এরিক হবসবম এর সব মতামত যে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে, তা অবশ্যই নয়। বস্তুত জ্ঞানচর্চার জগতে, বিশেষত সমাজবিজ্ঞান চর্চায় শেষকথা বলে কিছু হয় না। কিন্তু কোন কোন নিপুণ ভাষ্যকার যখন তাঁর বিশ্লেষণের সাহায্যে একটা বিষয় বা পর্বকে আলোকিত করে তোলেন, তখন চিন্তা চর্চার অনেকগুলো দুয়ার খুলে যায়। ইতিহাসকার বা সমাজ বৈজ্ঞানিকের স্বার্থকতা সেখানেই আর আমাদের শ্রদ্ধেয় এই ঐতিহাসিক তাঁর লেখা একের পর এক বইতে সেই কাজটা অনন্য দক্ষতায় সম্পন্ন করে সমাজ বিজ্ঞান চর্চার জগতে অতি বিশিষ্ট আসন লাভ করেছেন।

ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘লো ল্যাণ্ড’ নিয়ে কথাবার্তা


সত্তর দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলন একটা তরঙ্গ তুলেছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার আগেই খানিকটা তত্ত্ব-প্রয়োগের নিজস্ব জটিলতায় এবং মূলত রাষ্ট্রশক্তির দানবীয় আক্রমণের সামনে তার প্রথম পর্বটির অবসান ঘটে। আন্দোলন এবং সংগঠন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষাটা মরে নি। আশি এবং নব্বই এর দশকে বিহারে লিবারেশন গোষ্ঠী এবং অন্ধ্রপ্রদেশে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী বড় মাত্রায় জনসমর্থন অর্জন করে এবং নকশালবাড়ির রাজনীতিকে অনেকাংশে স্মৃতি থেকে সত্তায় ফিরিয়ে আনে। সি পি আই(মাওবাদী) গঠনের পর তা ছত্তিশগড়ে কিছু চমকপ্রদ সামরিক হানাদারি চালায় রাষ্ট্রের ওপর, তৈরি করে তথাকথিত রেড করিডর এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একে ‘আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার ভয়াবহতম চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এই নতুন তরঙ্গের ঢেউ জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে নয়ের দশকের শেষেই পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল, কিন্তু তা সর্বস্তরে বিরাট আলোড়নের কেন্দ্রে আসে একুশ শতকের প্রথম দশকের শেষ কয়েক বছরে। লালগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূলত এই সামনে আসা। এই দ্বিতীয় তরঙ্গের পশ্চিমবঙ্গ অধ্যায়টি চার দশক আগের প্রথম অধ্যায়টির মতো আবারো রাষ্ট্রশক্তির দমনের মুখোমুখি হয় এবং তাদের অন্যতম রাজনৈতিক মুখ কোটেশ্বর রাও বা কিষাণজীর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই তরঙ্গের সমাপ্তি হয়। কোটেশ্বর রাও এর হত্যাকাণ্ডের সময়কাল ছিল ২০১১ র নভেম্বর। নকশালবাড় আন্দোলনের প্রথম প্রবের মতো এই দ্বিতীয় পর্বটিও ছিল সংক্ষিপ্ত। কিন্তু প্রথম পর্বের উন্মাদনা সঞ্চার করা বা জন জাগরণের কাছাকাছি পৌঁছানো তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বিশেষ করে ছাত্র যুবদের মধ্যে আলোড়ন প্রথম পর্বের তুলনায় ছিল নেহাৎই সীমিত।
কেন এরকম পরিবর্তন ? এটা কি আন্দোলনের ভেতরকার উপাদানের বিরাট পার্থক্যের প্রতিফলন ? নাকি বদলে যাওয়া ছাত্র যুব মানসিকতা এর পেছনে ক্রিয়াশীল ? আজকের যুবসমাজ কীভাবে দেখে এই সমস্ত বিপ্লব প্রচেষ্টাকে ? সেই দেখার নিশ্চিত কোনও একটি ধারা নেই। আছে অনেক রকম দৃষ্টিকোণ। সেই দৃষ্টিকোণের নানাত্বকে বোঝা দরকার। শিল্পে সাহিত্যে ধরা পড়ে এগুলি। নকশালবাড়িকে ঘিরে প্রথম পর্বের অবসানের পর এক ধরণের গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা, নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট, যুদ্ধ পরিস্থিতি, সমরেশ মজুমদারের কালবেলার মত জনচিত্তজয়ী আখ্যানগুলি নকশালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতিকে দেখার প্রশ্নে অনেক আবেগ তাড়িত। কিন্তু এই সময়ে নকশালবাড়ি নিয়ে যে সমস্ত আখ্যান লেখা হচ্ছে, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কেউ যদি তা লেখেন – সেখানে কীভাবে ধরা পড়ে এই আন্দোলন ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই মনে হল বোঝা দরকার ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘লো ল্যাণ্ড’কে। ঝুম্পার মতো নবীন প্রজন্মের লেখিকা, যিনি এখনকার কসমোপলিটন শহরের সামাজিকভাবে অগ্রসর যুব সমাজের স্বচ্ছন্দের ভাষা ইংরাজীতেই লেখেন তার কাহিনী – তিনি কীভাবে দেখছেন নকশালবাড়ি ফেনোমেননটিকে ? এই জিজ্ঞাসা থেকেই আমাদের ‘লো ল্যাণ্ড’কে দেখার একটা আগ্রহ তৈরি হয়।



ঝুম্পা লাহিড়ীর লো ল্যাণ্ড : একটি হত্যাকাণ্ড ও তার ছায়া মানব মানবীরা


ঝুম্পা লাহিড়ীর লো ল্যাণ্ড বা নাবাল জমি ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্ত কীভাবে পরিবারের ওপর নিবিড় ছায়া ফেলেছে তার অন্তরঙ্গ কাহিনী। চল্লিশের দশকে কোলকাতায় জন্ম নেওয়া দুই ভাই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে তাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। বড় সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর দু বছরের ছোট উদয়ন পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে শুরু করে প্রেসিডেন্সি কলেজে। ষাটের দশকের শেষের দিকের সেই সময়টা নকশালবাড়ি আন্দোলনের উত্থান বিকাশের সময়। সুভাষ আন্দোলনে অংশ নেয় নি, হয়ত একে খুব সমর্থনও করে নি। আন্দোলন শুরুর দুবছর পর নতুন পার্টি সি পি আই (এম এল) গঠনের সময় সে পড়াশুনো করতে পারি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ছোট ভাই উদয়ন ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে যায় আন্দোলনের সঙ্গে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের নানা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, নানা ভাষ্য, কার্যকলাপের বিবরণ এখানে আছে। ঝুম্পা লাহিড়ী আন্দোলনকে চুলচেরা যুক্তিকাঠামোয় ঠিক ভুলের নিরিখে বিচার করতে যান নি। সেটা এই আখ্যানের লক্ষ্যবিন্দুও ছিল না। আখ্যানকার চেয়েছিলেন এই আন্দোলনের সূত্রে একটি পরিবারের বিভিন্ন চরিত্র যে সমস্ত ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেল, যে সমস্ত সম্পর্কের ওঠাপড়া প্রত্যক্ষ করল, তার এক অন্তরঙ্গ বয়ান রচনা করতে।
চারু মজুমদারের আহ্বানে উদ্দীপ্ত কোলকাতার ছাত্রযুবরা তখন নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেবার স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন দেখছে সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার। আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই যে সমস্ত রণনীতি চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন পার্টি গ্রহণ করে তাকে ঢুকে পড়ে ব্যক্তিহত্যা। এলাকার সাধারণ পুলিশকর্মী থেকে বিরোধী পার্টির কর্মী – লক্ষ্যবস্তু বানানো হতে থাকে নির্বিচারে। নানা নাশকতা ঘটানো হয়, অনেক নাশকতার পরিকল্পনা চলতে থাকে। এর বিপরীতে রাষ্ট্রের দিক থেকেও নেমে আসে নির্মম দমন পীড়ণ। যে ঘটনাটির স্মৃতি এই উপন্যাসে সারাক্ষণ তার ছায়া বিস্তার করে থেকেছে, নিজেদের বাড়ির কাছের নাবাল জমিটিতে উদয়নের হত্যা – সেটি এরকম অসংখ্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরই একটি। সুভাষের কাছে গৌরীর বর্ণনা সূত্রে ঘটনাটির অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা এসেছে উপন্যাসে।
ঘটনার আগে থেকেই অবশ্য উদয়ন এই ধরণের কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল। একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর ছাড়া পেলেও সে জানত পুলিশের নজর তার ওপর থাকবেই। টলি ক্লাবে নাশকতার পরিকল্পনাকারী বা এলাকারই এক পুলিশকে হত্যার অন্যতম ক্রীড়নককে গোয়েন্দা ও পুলিশ বিভাগ স্বাভাবিকভাবেই নজরে রাখত। সমস্তকিছু বিস্তারিতভাবে না জানলেও মা বাবা বা স্ত্রী গৌরী অনুমান করত বিপদের গভীরতা আর তাই সকলের মিলিত সিদ্ধান্তে বাড়িতেই আত্মগোপন করে ছিল উদয়ন। গৌরীকে পালানোর সম্ভাব্য এলাকা বা পথও জানিয়ে রেখেছিল আগে থেকেই। শেষপর্যন্ত পুলিশ যেদিন এল বাড়ির পাশের জলা নাবাল জমিটিতে আশ্রয় নিলেও শেষরক্ষা হয় নি। উঠে আসতে হয়েছিল কচুরীপানা মাখা অবস্থায় জখম ব্যাণ্ডেজ বাঁধা একটি হাতে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। বাবা মা স্ত্রী ছাদ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অধ্যায়টুকু। গ্রেপ্তারীর নাটক আর তারপর ঠান্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে হত্যা। লাশ নিয়ে পুলিশ ভ্যানের চলে যাওয়া। উদয়নের মৃতদেহ আর কোনদিনই ফেরৎ পাওয়া যায় নি। রাষ্ট্রও স্বীকার করে নি এই ধরণের হত্যাকাণ্ডের কথা।
উদয়নের মৃত্যুর খবর পেয়ে দাদা সুভাষ আমেরিকা থেকে ফেরে। প্রথম আলাপ হয় গৌরীর সাথে। মায়ের থেকে জানতে পারে গৌরী উদয়নের সন্তানের মা হতে চলেছে। গৌরী যে পরিবারে গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল না উদয়নের মৃত্যুর পর, সেটা সুভাষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। গৌরী ও তার আগত সন্তানের কথা ভেবে, হয়ত উদয়নের কথা ভেবেও সুভাষ গৌরীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। সুভাষের বাবা মা খুশি না হলেও গৌরী শেষপর্যন্ত আমেরিকা চলে আসে। সেখানেই সুভাষের সঙ্গে শুরু হয় তার এক জটিল দাম্পত্য। জন্ম নেয় কন্যা বেলা, যে জীবনের প্রথম তিনটি দশক নানা উত্থান পতনের মুহূর্তেও কখনোই জানতে পারে নি সুভাষ তার জন্মদাতা বাবা নয়, পালক পিতা।
বস্তুতপক্ষে নকশালবাড়ি আন্দোলন বা উদয়ন হত্যাকাণ্ডের ছায়ার মধ্যে এই আখ্যান বরাবরই ঘোরাফেরা করেছে এবং টালিগঞ্জ থেকে হাজার হাজার মেইল দূরে আমেরিকার পূর্বপ্রান্তে গিয়েও সেই ছায়া থেকে উপন্যাসের প্রধান পাত্রপাত্রীরা বেরোতে পারে নি। নিশ্চিতভাবেই ঝুম্পা লাহিড়ী ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডটির ছায়া আখ্যানে বরাবর রেখেছেন, কিন্তু কোনও সস্তা মেলোড্রামায় কাহিনীকে কখনো আক্রান্ত হতে দেন নি।
এই নিরিখে গৌরী চরিত্রটিই সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ ছিল এবং উপন্যাসে সবচেয়ে বহুকৌণিক অবস্থান থেকে তাকেই নির্মাণ করেছেন আখ্যানকার। সুভাষ প্রত্যক্ষত উদয়ন এবং তার হত্যাকাণ্ডের ছায়ার বাইরে আসতে চেয়েছিল, যদিও উদয়ন বা আশৈশবের ছায়াসঙ্গীকে বিস্মৃত হয়ে নয়। সমস্ত স্মৃতিকে নিয়েই সে গৌরীর স্বামী এবং পালক পিতার বদলে পিতা হয়ে উঠতে চেয়েছিল। ঝুম্পা লাহিড়ী এই বইটি সম্পর্কে নিজেও বলেছিলেন পরিবারকে কেন্দ্র করে কিছু প্রশ্ন এবং নিরীক্ষার সামনে তার চরিত্রদের তিনি দাঁড় করিয়েছেন এখানে। আমরা আখ্যান বিশ্লেষণ করেই বুঝি বা বেলার আচরণে – পিতৃত্বের প্রশ্নে সুভাষ এর আন্তরিকতা কোনও প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়বে না। এমনকী প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছে সুভাষ শেষপর্যন্ত যখন বেলার মা গৌরীকে ডিভোর্স করে নতুন জীবন সঙ্গিনী খুঁজে নিচ্ছেন, তখন বেলার তাতে সাদর সম্মতি। একই বাড়িতে সে তার মেয়েকে নিয়ে থাকছে যে বালিকাকেও জানানো হয়েছে তার দাদুর আসন্ন বিয়ের খবর।
কিন্তু এই বেলাই মেয়ে হয়েও কঠোরতমভাবে প্রত্যাখ্যান করে নিজের মাকে। জন্মদাতা পিতার মৃত্যুর স্মৃতিকাতরতাই গৌরীর সব ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ – এটা বেলা মনে করে নি। মেয়ে বেলাকে নাবালিকা অবস্থায় ছেড়ে, স্বামী সুভাষকে ছেড়ে গৌরীর চাকরী নিয়ে ক্যালিফর্ণিয়ায় চলে যাওয়া এবং কোনও যোগাযোগ না রাখাকে সে প্রেমিক স্বামী উদয়নের ঘটনাবলীর যৌক্তিক পরম্পরা বলে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত ছিল না।
গৌরীর চলে যাওয়া কতটা উদয়নের স্মৃতির বাইরে বেরনোর অপারগতা থেকে আর কতটা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে নিজের মতো গড়ে পিঠে নেবার – এ প্রশ্ন পাঠককে বিদ্ধ করবেই। গৌরী যদি রোড আইল্যাণ্ডের বাড়িতে বিষণ্ণ একাকিত্বে নিজেকে আলাদা করে নিত তবে কি বাঙালি সাবেকিয়ানার মন আস্বস্ত হত ? প্রশ্নটা অবশ্যই ফেলে আসা মৃত স্বামীর জন্য গোপন অশ্রুবর্ষণ এর পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয়তা বনাম পাশ্চাত্যের বন্ধনমুক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার নয়। প্রশ্নটাকে ঝুম্পা লাহিড়ী দ্বিতীয় প্রজন্মের পাশ্চাত্যবাসী হিসেবে সেভাবে দেখতেও চান নি। প্রশ্নটা তার কাছে আমাদের সরল প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের বিভাজন ছকে ধরা দেবার কোনও কারণ ছিল না, কারণ সেরকম ছক আমাদের কল্পনা নির্মাণের বাইরে বাস্তবে অবস্থান করেও না। ঝুম্পা পরিবার, মায়ের দায়িত্ব এই প্রশ্নগুলিকে অবশ্যই গৌরীর জীবন বিশ্লেষণের সূত্রে তুলতে চেয়েছেন এবং এই প্রশ্নগুলি যে কোন সমাজের কিছু মৌলিক বিষয় হিসেবেই অবস্থান করে, প্রাচ্য পাশ্চাত্য বিপরীত দৃষ্টিকোণ সেখানে খোঁজার কোনও মানে হয় না।
গৌরীর স্বাধীন জীবন বেছে নেওয়া, তার সমকাম ও বিপরীতকাম সহ বিভিন্ন ধরণের যৌন ও যৌথ যাপনকে অবশ্যই ঝুম্পা কোনও নীতির প্রশ্নে দেখতে চান নি, দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন পাশ্চাত্যবাসী আখ্যানকারের সেরকম দেখার চোখ থাকার কথাও নয়। আমাদের কাছে আখ্যানকার গৌরীকে সমস্যায়িত করেন তার যৌন স্বাধীনতাকে বেছে নেবার সূত্রে নয়, তার শিশু সন্তান এবং পরিবারের প্রতি দায়হীন স্বার্থপরতার জন্য। পশ্চিমী সমাজতত্ত্বে অনভিজ্ঞ আমাদের কাছে পরিবার ও সন্তানের দায় দায়িত্বের নৈতিক অবস্থান এর মানদণ্ড বা ভারসাম্য বিন্দুটির অবস্থান অবশ্যই খুব স্পষ্ট নয়, তবে ঝুম্পার ট্রিটমেন্ট থেকে মনে হয় মৌলিক কিছু দায়বদ্ধতার থেকে, পিতৃত্ব মাতৃত্ব (ঝুম্পা সাক্ষাৎকারে পেরেন্টহুড শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যার প্রতিশব্দ যোজনা মুশকিল) সংক্রান্ত দায় দায়িত্ব থেকে কোনও সমাজই সেভাবে মুক্ত নয়। গৌরী এই দায়গুলি গ্রহণ করে নি শুধু তাই নয়, এই দায় গ্রহণে তার অপারগতার কথা জানানোর প্রয়োজনও সে বোধ করে নি। মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগহীনতায় তার অপরাধবোধ নিশ্চয়ই কার্যকরী হয়েছে, কিন্তু তা তার দায়িত্বহীনতাকেই বাস্তবে বহুগুণিত করেছে। যে একসময় সুভাষের মর্মব্যথার কেন্দ্র ছিল, নিস্পৃহ দাম্পত্যের যন্ত্রণা দেওয়া সত্ত্বেও সুভাষের দিক থেকে ভালোবাসার সঙ্গিনী ছিল, সেই ক্রমশ হয়ে দাঁড়ালো তার বীতরাগ আর ঘৃণার পাত্রী। এই রূপান্তরে অবশ্যই গৌরীর দায় ছিল।
এতদস্বত্ত্বেও গৌরীর জীবনবৃত্তের নির্বাচনকে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা স্বেচ্ছাবিহারিণী দায়হীন স্বার্থপরতার ছকে ব্যাখ্যা করা অবশ্যই অতি সরলীকরণ হবে এবং আখ্যানকার ঘটনা সন্নিবেশে বা আখ্যানের পরতে এমন কোনও সরলীকরণের প্রশ্রয় রাখেন নি। যে মানসিক প্রতিকূল পরিবেশে সে তার পড়াশুনোকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা বিদ্যাচর্চায় তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহেরই সূচক। আখ্যানের শেষপর্বে উদয়ন গৌরী প্রেমপর্বের কিছু মুহূর্তকে যখন ফিরিয়ে আনেন ঝুম্পা তখন আমরা উদয়নের চোখেও পাঠে একান্ত আসক্তা গৌরীকেই দেখতে পাই। রোড আইল্যাণ্ডে দর্শনের ক্লাসে তার প্রথমদিকে চলে যাওয়াটা দুঃসহ একাকীত্ব কাটানোর এক প্রয়াসই ছিল। প্রেসিডেন্সীর একদা মেধাবী এই ছাত্রীটি সন্তানের জন্মের পরে বিদ্যায়তনিক সেই পরিধি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় নি। কোনও নারীবাদী পাঠ কি এই প্রশ্ন তুলতে পারে না ব্যাপ্ত সুযোগের সদব্যবহারের তাগিদে ক্যালিফোর্ণিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে গৌরীর চলে আসাটাকে এত নেতিবাদী দৃষ্টিকোণে দেখার কারণ কি ? পরিবার ছেড়ে দেশ ছেড়ে সুভাষের আমেরিকা পাড়ি দেওয়ায় তো প্রথমে পারিবারিক, বিশেষ করে মায়ের গর্বই ধ্বনিত হয়েছিল। পরে মা বাবার কাছে না ফেরা সুভাষ তো সেভাবে ধীকৃত নন, অন্তত গৌরীর মত নন কোনওভাবেই। বাবা মার প্রতি ‘দায়বদ্ধতা’র অভাব কি ভাইয়ের মেয়ের পালক থেকে প্রকৃত পিতা হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে শেষমেষ স্খলিত হয়ে গেছে ? যা গৌরীর ক্ষেত্রে ঘটে নি ?
গৌরীর যন্ত্রণাকে কোনও সময়েই অবশ্য মুছে যেতে দেখি নি এবং ক্যালিফোর্ণিয়া বাস পর্বে বিভিন্ন যৌন ও যৌথ জীবন যাপনের পর্বে সে কতটা খুশি কতটা নিস্পৃহ বা কতটা বীতস্পৃহ তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, হয়ত গৌরীর নিজের কাছেও নয়। বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্রে সাফল্য নিশ্চিত তার আকাঙ্ক্ষিত ছিল, কিন্তু সেটি যে চরম কোনও প্রাপ্তি তার ক্ষেত্রে হতে পারে নি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না। বিশেষত দশকের পর দশক যে সুভাষের সঙ্গে মেয়ে বেলার সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না, তাদের থেকে প্রত্যাখ্যানের স্পষ্ট উচ্চাররণগুলির মুহূর্তে, সে নিজের স্থিতিকে হারিয়ে ফেলেছিল। তখন একই সঙ্গে সে যেন স্মৃতি অতীত ভবিষ্যৎ যাবতীয় সম্ভাবনা সহ সব হারানো একজন। নিজের কাছে গৌরীর হারানো প্রাপ্তির হিসাবটা কি দাঁড়াল সেটাই যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তখনই আবার কন্যার থেকে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার ক্ষীণ আভাস নিয়ে এলো এক বার্তা আর সেটাই কি উদয়নের সঙ্গে সম্পর্ক শুরুর স্মৃতির আবহে প্রত্যক্ষভাবে ফিরে গিয়ে তাকে ভবিষ্যতের বাকী দিনগুলোর জন্য স্মৃতিতে আশ্রয় নেবার প্রেরণা দিল ? নিশ্চিতভাবে প্রশ্নগুলির নির্দিষ্ট সর্বসম্মত কোনো উত্তর হয় না এবং দেশকাল ব্যক্তিমানস ভেদে এ নিয়ে বহু অবস্থানই স্বাভাবিক। সমস্যাটিকে জটিলতায় ধরতে চেয়েছেন আখ্যানকার; ইতিহাসের অভিঘাত, পরিবার, পেরেন্টহুড, স্বাধীনতা, দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা, একাকিত্বের বহুকৌণিক প্রশ্নগুলিকে রাখতে চেয়েছেন ভাবনা চিন্তার নানাত্বকে সামনে আনার জন্য - আর তাতে তিনি বিশেষভাবেই সফল।


Thursday, September 27, 2018

প্রীতম বসুর চৌথুপীর চর্যাপদ : ফেলা আসা অতীতের জ্ঞানবিজ্ঞান জগতের গল্পকথা


চৌথুপীর চর্যাপদ প্রীতম বসুর দ্বিতীয় আখ্যান, যেখানে তিনি পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল এর পরে আরেকবার বাঙালি জীবনের এক উতরোল সময়ক্ষণের পুনঃনির্মাণে প্রয়াসী হলেন। পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের মতো এই আখ্যানেও প্রাচীন সাহিত্যকীর্তি ও পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী আবিস্কারের সূত্রে একটি থ্রিলারের জন্ম দেন কথক। এখানেও পঞ্চাননমঙ্গলের মতোই দুটি ভিন্ন সময়ের আখ্যান দ্বিবেণীবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলে। পঞ্চাননমঙ্গলে যদি থেকে থাকে বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষাভঙ্গীতে লেখা কাব্য অংশ তো এখানে রয়েছে আরো প্রাচীন চর্যাপদের আদলের পদাবলী পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির বাইরের আদলটিই যেমন শুধু কাব্যের আর ভেতরে রয়েছে গণিতের নানা সূত্র, তেমনি এখানেও পদাবলিগুলি জ্যোতির্বিজ্ঞান,নানা ওষধি ও ভেষজ শাস্ত্রের আকর। চৌথুপীর চর্যাপদ লেখকের পরবর্তী উপন্যাস হলেও এর সময়কাল পঞ্চাননমঙ্গলের চেয়ে অন্তত দুশো বছরের পুরনো। পঞ্চাননমঙ্গলের প্রাচীন আখ্যানটির সময়কাল পঞ্চদশ শতকের প্রথম ভাগ আর চৌথুপীর চর্যাপদের ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়া, যখন বাংলায় তুর্কি আক্রমণ সদ্য শুরু হয়েছে। বস্তুতপক্ষে তুর্কি আক্রমণে বিধ্বস্ত বাংলার ছবিটা দুটি আখ্যানেই আমরা পাই, পাই সেই বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের হাত থেকে নিজের অতীত ইতিহাস জ্ঞান বিজ্ঞানকে রক্ষার মরীয়া চেষ্টা।
প্রীতম বসুর দুটি আখ্যানই ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের প্রয়োজনে যথেষ্ট গবেষণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। আবার এই গবেষণাই কোথাও কোথাও লেখককে প্রলুব্ধও করেছে আখ্যানের গতিকে থামিয়ে তথ্য পরিবেশনে। বিশেষ করে চৌথুপীর চর্যাপদের সাম্প্রতিক সময়ের আখ্যান অংশটির চরিত্র পাত্ররা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চরম সঙ্কটজনক কিছু মুহূর্তেও যেভাবে অতীতের তথ্য উদগীরণ করতে থাকে, তার আখ্যানগত বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠেছে এই দুটি আখ্যানেই ইসলামোফোবিয়ার উপাদান আছে কীনা তা নিয়ে। আমরা পরে এই প্রশ্নটির মুখোমুখি হব। তার আগে বলা দরকার চৌথুপীর চর্যাপদের বিশিষ্টতার জায়গাগুলি নিয়ে।
এই আখ্যানের সমকাললগ্ন যোজনগন্ধা কেন্দ্রিক আখ্যানটি মাঝে মাঝেই গতি হারিয়েছে, পট পরিবেশের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তিও আমরা পেয়েছি মামাজীর কাছে পাত্রপাত্রীদের বন্দীদশার দীর্ঘ পর্বটিতে। এই দুর্বলতার উল্টোদিকেই রয়েছে গন্ধকালী কেন্দ্রিক প্রাচীন আখ্যানটি, যেখানে প্রীতম বৌদ্ধ পরিবেশের অসামান্য পুনঃনির্মাণ ঘটান। শুধু যে প্রাচীন অংশটির আখ্যানবিন্যাস এখানে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তাই নয়, যুগের আবহটি ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও লেখক বিশেষ সাফল্য পেয়েছেন। আর অতি অবশ্যই বলতে হয় গন্ধকালী চরিত্রনির্মাণ প্রসঙ্গে। এক গ্রাম্য বালিকা, যার এমনকী পাঠশালায় যাবার অনুমতি পর্যন্ত মেলে নি এক সময়, সে কী করে সমকালীন জ্যোতির্বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ বিদুষী হয়ে উঠল, হয়ে উঠল ভেষজ বিষয়েও পারঙ্গম, তার নাটকীয় আখ্যান এখানে আছে। কিন্তু গন্ধকালীর বিদুষী থেরী সঞ্জীবনীতে রূপান্তরণের মধ্যে দিয়েই তার জীবনবৃত্ত শেষ হয়ে যায় নি। তিব্বতী রাজকুমার খু স্তোন এর সাহচর্যে তার চাপা থাকা নারীত্বের দিকগুলি অগ্নিস্ফুলঙ্গের মতো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। থেরীর জীবন থেকে সে আবার সরে আসে গন্ধকালীর সাংসারিক নাম পরিচয়ে।
সমকাললগ্ন আখ্যানটির কেন্দ্রীয় চরিত্র যোজনগন্ধা পুরাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, ‘সিদ্ধমাতৃকা : সিক্রেট কোডস অব ট্যানট্রিকস’ নামের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক বিখ্যাত এক বইয়ের লেখিকাতাঁর বাবা ডক্টর বুধাদিত্য চ্যাটার্জিও ছিলেন পুরাতত্ত্বের পণ্ডিত ও আবিষ্কারকপুরাতাত্ত্বিক আবিস্কারের নেশাতেই একসময় তাঁর প্রাণ যায়। যেখানে তিনি মারা গিয়েছিলেন সেই চৌথুপী আরেকবার উঠে আসে খবরে। একটি মূর্তি উদ্ধার ও খুনের সূত্রে। যোজনগন্ধা ক্যান্সার আক্রান্ত, তার অপারেশনের দিন নির্ধারিত হয়ে আছে। তবু এই বিশেষ জায়গাটির আকর্ষণে সে দুদিনের জন্য প্লেনে করে পাড়ি দেয় উত্তরবঙ্গের উদ্দেশ্যে। ঘটনাচক্রে এই দুদিন বেড়ে যায় দু সপ্তাহেযোজনগন্ধা ও অন্যান্যরা মামাজী নামের এক ব্ল্যাকমেলারের হাতে বন্দী হয়। এই ঘটনাবহুল সফরকালেই হঠাৎ পাওয়া গন্ধকালীর লেখা এক চর্যাপদের পুঁথি হাতে আসে যোজনগন্ধার। সে এর পাঠে নিবিষ্ট হয়। ঘটনার নানা আবর্তে তার সহপাঠক হিসেবে আসেন তিব্বতী এক লামা, লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল, যিনি ভেষজ বিদ্যায় ও সিদ্ধম লিপি তথা বৌদ্ধ শাস্ত্রে পারঙ্গম। উভয়ে মিলে গন্ধকালীর ‘হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষায় লেখা বৌদ্ধ গান ও দোহা’গুলি আজকের ভাষায় পড়ে ফেলেন। বস্তুত গন্ধকালী কাহিনিটিই এই উপন্যাসের মূল মর্মবস্তু।
গন্ধকালী ছিলেন উত্তর বাংলার এক গ্রাম্য ধীবরের কন্যা। বাল্যে তাকে ডাকাতেরা অপহরণ করেছিল, তাই সংসারের স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে সমাজ তাকে দূরে রেখেছিল। সেই সময়কালটা ছিল বাংলায় তুর্কি আক্রমণের প্রথম পর্ব। ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাহিনী তখন একের পর এক মন্দির, বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করছে, সেখানকার পুঁথিপত্র জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্মমভাবে হত্যা করছে সেখানকার মানুষকে, তাদের ওপর জোরজুলুম করে চাপিয়ে দিচ্ছে নিজেদের ধর্ম। এই সময়েই গন্ধকালী নদীর বুক থেকে উদ্ধার করেন বৌদ্ধ আচার্য শ্রীধর পণ্ডিতকে। জ্যোতিষ শাস্ত্রের দিকপাল পণ্ডিত আচার্য শ্রীধর ছিলেন নালন্দা, বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রাক্তন অধ্যাপক, শিলাদিত্য সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষ।  শিলাদিত্য সঙ্ঘারাম তুর্কি আক্রমণে ধ্বংসের সময় সেখান থেকে কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে তিনি পালিয়ে আসেন। মৃতপ্রায় শ্রীধর আচার্যকে সুস্থ করে তোলেন গন্ধকালী ও তার বাবা চন্দর মাঝিসেখানেই ছেলেদের পড়ানোর কাজে যুক্ত হন শ্রীধর। এমন পণ্ডিতকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে গ্রামবাসীরাও খুশি হয়। কিন্তু বিবাদ বাঁধে গন্ধকালী বিদ্যাশিক্ষায় যুক্ত হলে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে শ্রীধর পণ্ডিতের শাস্ত্রের নিদান ভিত্তিক যুক্তিমালাও সমাজের কিছু মুরুব্বীকে আশ্বস্ত করে নি। লোপামুদ্রা, বিশ্ববারা, সিকতা, নিভাবরি, ঘোষা, মৈত্রেয়ী, গার্গি প্রমুখ প্রায় কুড়িজন বিদুষী মহিলার রচিত স্তোত্র যে ঋকবেদে আছে – এই তথ্যকেও তারা আমল দিতে প্রস্তুত হয় নি। পরিবেশ পরিস্থিতির জটিলতা শেষপর্যন্ত গন্ধকালীকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে। কিন্তু তার মধ্যেই শ্রীধর পণ্ডিতের শিক্ষা এবং নিজের ধীশক্তির সমন্বয় তাকে একজন পারঙ্গম জ্যোতির্বিদ করে তুলেছে অতি অল্প বয়সেই। ঘটনার বিচিত্র আবর্ত পেরিয়ে শেষমেষ গন্ধকালী নানা বাধা অতিক্রম করে এসে হাজির হয় চৌথুপী বিহারে, যা ছোট হলেও জ্ঞানচর্চার এক প্রশংসনীয় কেন্দ্র ছিল। বিশেষ করে এর জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগটি ছিল ফলিত ও তাত্ত্বিক চর্চার এক উন্নত প্রতিষ্ঠান। সে যুগের দুই শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ শান্তভদ্র ও তিব্বতী আচার্য তোন পা ছিলেন এর দুই স্তম্ভ। আর শীর্ষে ছিলেন সদ্য তরুণী গন্ধকালী, যিনি ততদিনে রূপান্তরিত হয়েছেন থেরী সঞ্জীবনীতে।
অতীতের এই মূল কাহিনীটির সঙ্গে এসে মিশেছে একটি ছোট তিব্বতী উপকাহিনীও। যেখানে আমরা দেখি তিব্বতের রাজা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। তিব্বতে এর চিকিৎসা নেই, কিন্তু ভারতে আছে। কুষ্ঠের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছে রাজপুত্র খু স্তোনেরও। হাজার হাজার তিব্বতবাসীও এতে আক্রান্ত। নিজের, পরিবারের ও দেশের রোগ মুক্তির উপায় খুঁজতে বিঘ্নসঙ্কুল পথ পেরিয়ে খু স্তোন হাজির হন ভারতে। পথে তার সমস্ত সঙ্গীরাই মারা যান শত্রু আক্রমণে। ভারতে আসার পথে খবর পান তার কাকা তার বাবাকে বন্দী করে নিজেই সিংহাসন দখল করেছেন। ভারতে এসে খু স্তোন শেষমেষ এসে পৌঁছন চৌথুপী বিহারে, সেখানেই তার সাথে সাক্ষাৎ হয় থেরী সঞ্জীবনীর।
চৌথুপীও তখন মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। যে কোনও মুহূর্তে তুর্কীরা এসে ধ্বংস করতে পারে বিহার ও তার পুঁথিশালা যেখানে রয়েছে পদ্মসম্ভব, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, প্রজ্ঞাকরমিতি, পণ্ডিত নারো পা, স্থবির বোধিভদ্র, শ্রীজ্ঞান মিত্রের মতো পন্ডিতদের লেখা বহু মহামূল্যবান পুঁথি আশেপাশের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বিহারগুলি থেকেও - যার অন্যতম বিক্রমশীল মহাবিহার - বেশ কয়েক হাজার পুঁথি তখন গোপনে এসে পৌঁছেছে চৌথুপীতে বাংলা তথা ভারতের জ্ঞানসাধনার সেই অমূল্য সম্পদগুলিকেও তুর্কী ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচানো নিয়ে সবাই চিন্তিত বেশ কিছু পুঁথি চৌথুপীর তিব্বতী পণ্ডিত তোন পার সহায়তায় তিব্বতে পাঠানো হয়েছে। বাকী আরো কয়েক হাজার পুঁথিকে এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় যাত্রার মধ্যে দিয়ে শত্রুর শ্যেন দৃষ্টি ও মাথার ওপর উদ্যত মৃত্যুর করাল ছায়া অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত তিব্বতে নিয়ে যান খু স্তোন ও থেরী সঞ্জীবনী। অবশ্য এই যাত্রায় থেরী সঞ্জীবনীর চীবর ছেড়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন পূর্ণ যৌবনা নারী গন্ধকালী। যুবরাজ খু স্তোনের সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হবার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে এই দুর্গম নাটকীয় অভিযাত্রার সময়। তিব্বতে গিয়ে কাকার হাত থেকে সিংহাসন মুক্ত করেছেন স্তোন পা, পিতার মৃত্যুর পর রাজা হয়েছেন। আর রণ কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার মিশেলে পরাজিত করেছেন আক্রমণকারী পরাক্রান্ত তুর্কি বাহিনীকে।
যেহেতু এই উপন্যাসে তুর্কী আক্রমণের ভয়াবহতা, তাদের বিধর্মীদের আক্রমণ, মঠ মন্দির ধ্বংস ও পুঁথি পোড়ানো ও হত্যালীলার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে,রয়েছে সে সম্পর্কে এই স্বাভাবিক বীতরাগের আবহও – তাই কেউ কেউ এই আখ্যান প্রসঙ্গে তুলেছেন ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ। বিশেষ করে এমন এক সময়ে এই আখ্যানটি পাঠকের সামনে হাজির হয়েছে যখন ইসলামোফোবিয়া দেশ দুনিয়া জুড়ে যথেষ্ট ব্যাপ্ত ও চর্চিত একটা বিষয়।
এই প্রসঙ্গে এটাই বলার যে এই সময়ের ইতিহাসকে আজকের সমাজ রাজনীতিতে টেনে যদি একটি ধর্মর মানুষজনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করার চেষ্টা করা হয় সমাজ বাস্তবতার দৈনন্দিনতায়, ইতিহাসের প্রতিশোধ নেবার ভাষ্যটি উদগ্র হয়ে ওঠে, যেমনটা কখনো কখনো হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় তাকে ইসলামোফোবিক বলে আখ্যাত করা সঙ্গত। কিন্তু প্রীতম বসু তুর্কী আক্রমণের সময়ের বাস্তবতার কোনও প্রতিস্পর্ধাকে সমকালে হাজির করার বয়ান হাজির করেন না, তার ইঙ্গিৎ মাত্রও দেন না। প্রীতম তুর্কী আক্রমণের প্রেক্ষাপটে তার এই আখ্যান নির্মাণ করেছেন এবং সেই সময়ের ইতিহাস স্বীকৃত আবহটিই তিনি নির্মাণ করেছেন মীনহাজ এর তবাকাৎ ই নাসিরি সহ সেই সময়ের স্বীকৃত ইতিহাসের উপাদানগুলি থেকে প্রীতম সরে যান নি এবং সেই নিরিখে তার এই আখ্যানের প্রতি ইসলামোফোবিয়ার অভিযোগ তোলা বাতুলতা
অবশ্য অতীত গৌরব ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অর্জনের কথাগুলি বলতে গিয়ে প্রীতম অতিরেক করেছেন, এই অভিযোগ অনেকদূর পর্যন্ত তথ্য সমর্থিত মহাভারতের কাল গ্রহ নক্ষত্রের গ্রহণের বিস্তারিত বিবরণ সূত্রে মেপে ফেলার অধ্যায়টিই হোক বা সে যুগে আলোর গতির পরিমাপ জানা থাকার প্রসঙ্গই হোকপ্রীতম কল্পনাকে বাস্তব তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি দূরে কোথাও কোথাও নিয়ে গিয়েছেন এটি আখ্যানমাত্র,ইতিহাস নয়,তাই আখ্যানকারের এমত কিছু স্বাধীনতা থেকেও যায় একথা যারা বলতে চান - তাদের বলা যেতে পারে এইসব অতিরেক বিপুল গবেষণার ভিত্তিতে আখ্যান নির্মাণের যে বিশিষ্ট অর্জন,তার দিকেই কিছু প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়
কিছু অতিরেক সত্ত্বেও গন্ধকালী আখ্যান নির্মাণ যে উচ্চতায় এখানে পৌঁছল, সমকালীন যোজনগন্ধা আখ্যানটি তার বিপরীতে কেন এত নিষ্প্রাণ ও স্থবির হয়ে রইলো তা পাঠককে ভাবাবেই। এখানে ঘটনা পরম্পরার অতি নাটকীয়তাই শুধু যে বিশ্বাসের বাস্তবতাকে আঘাত করে তাই নয়, সঙ্কট মুহূর্তে চরিত্র পাত্রদের আচার আচরণ ও দীর্ঘ দীর্ঘ বচনগুলিও অবিশ্বাস্য মনে হয়। বিশেষত আখ্যান কিছুদুর অগ্রসর হওয়ার পর যখন ব্ল্যাকমেলার মামাজীর অধীনে যোজনগন্ধা ও হাবিলদারের দীর্ঘ বন্দিদশা শুরু হয়, তখন থেকে আখ্যানও তার গতি হারিয়ে একই জায়গায় প্রায়শ পুনরাবৃত্ত ফলত ক্লান্তিকর হতে থাকে। যোজনগন্ধার আচার আচরণ সংগতিপূর্ণ হচ্ছে না এটা অনুভব করেই কি লেখক একদম শেষে ক্যান্সারের পাশাপাশি ডিসোসিয়েটিভ আইডেনটিটি ডিসঅর্ডার নামক তার এক মানসিক রোগের কথা পাঠককে জানিয়ে দেন ?
অতিরেকগুলি বাদ দিয়েও প্রীতম যেভাবে বাংলা তথা ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান জগতের বিশিষ্ট অর্জনগুলিকে একের পর এক তুলে আনেন, তার ধারাবাহিক চর্চার কথা বলেন – তা আমাদের জাতিগত গৌরবকে পুনঃনির্মাণের এক জরুরী চেষ্টা। আমাদের গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার ব্যুৎপত্তিই হোক বা ভেষজ চিকিৎসাশাস্ত্রের বিষ্ময়কর বিকাশই হোক, অনেক পরিশ্রমসাধ্য গবেষণার মধ্যে দিয়ে প্রীতম তার স্বাদু পরিবেশন করেছেন এখানে। অনেক প্রচলিত ধারণাকে উলটে পালটে দিয়েছেন। অনেক নতুন তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে আমাদের অতীতের প্রতি বিষ্ময়মুগ্ধ ভালোবাসার বোধ জাগিয়ে তুলেছেন, যা চৌথপীর চর্যাপদের অন্যতম অবদান।
ভারতীয় ভেষজের আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে এবং তার সন্ধানে বে আইনি কারবারের চেষ্টা আমরা সংবাদপত্রের পাতায় মাঝেমাঝেই দেখতে পাই। প্রীতম আমাদের জানিয়েছেন কিড়াজড়ি নামে লোকমুখে জনপ্রিয় এক ঘাসের কথা, যার রয়েছে যৌবন প্রদীপ্ত করার অনবদ্য শক্তি। জানিয়েছেন ডাকিনী ব্রহ্মকালির বইয়ের সূত্রে এ সম্পর্কে আমাদের দীর্ঘকালীন চেনাজানার কথা। ডাকিনী শব্দের বর্তমান লোক প্রচলিত অর্থের সাথে প্রকৃত অর্থের পার্থক্যটি ধরিয়ে দিয়ে প্রীতম জানিয়েছেন বিদ্যার সঙ্গে শব্দটির সংযোগের কথা, ডাক ও খনার বচন কথাটির মধ্যে যা ধরা আছে। গন্ধকালীর শিক্ষাসূত্রে এখানে এসেছে ভারতের জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার মহান ঐতিহ্যের কথা। আর্যভটের আর্যভটীয়, ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত ছাড়াও এসেছে পরাশর সিদ্ধান্ত, অত্রি সিদ্ধান্ত, গর্গ সিদ্ধান্ত, সূর্য সিদ্ধান্ত, মরীচি সিদ্ধান্ত, অঙ্গিরস সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বইগুলির কথা। এসেছে ফলিত জ্যোতিবির্জ্ঞান চর্চায় সেকালের মানমন্দিরে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রের প্রসঙ্গ, যার মধ্যে ছিল জলঘড়ি, শঙ্কু, ফলক যন্ত্র, কপাল যন্ত্র, দোলন যন্ত্র ইত্যাদি।
বিষ এবং ওষধি সম্পর্কে ভারতীয় ভেষজবিদ ও চিকিৎসকদের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডারের কিছু কিছু নিদর্শন গন্ধকালীর বইয়ের সূত্রে এখানে হাজির করেছেন আখ্যানকার। সেই হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান পুনরুদ্ধারে বিশ্বের তাবড় তাবড় ওষুধ কোম্পানির আগ্রহ ও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের কথাও জানিয়েছেন। চাণক্য বর্ণিত মারাত্মক বিষ বা ক্ষুদাহরণকারী ওষুধের কথা এখানে এসেছে। লামা লবসাঙ চ্যোগিয়্যাল জানিয়েছে মৌর্যযুগের সেনাদের একপ্রকার ক্ষুধাদমনকারী ওষুধ দেওয়া হত, যা খেয়ে পনেরোদিন বা এক মাস সেনারা খাদ্যাভাবেও যুদ্ধ করতে পারত। নারীদের ঋতুবন্ধ করার ওষুধও সেকালে জানা ছিল বলে লামার মুখ থেকে শুনি আমরা, শুনি চাণক্য বর্ণিত সেযুগের একধরনের কেমিক্যাল ওয়েপেনের কথা
আমাদের অতীতের জ্ঞানবিজ্ঞানের দিকে নজর ফেরানো, নিজের ইতিহাস ঐতিহ্য শিকড়কে শ্রদ্ধা করতে ভালোবাসতে শেখা প্রীতম বসুর প্রথম উপন্যাস পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, সেই লক্ষ্য চৌথুপীর চর্যাপদেও বর্তমান। এই ধারায় বাংলায় সাম্প্রতিক কালে আরো উল্লেখযোগ্য লেখালেখি শুরু হয়েছে, তা পাঠকদের কাছে বিপুল সমাদরও পাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের একটি ইতিবাচক দিক।

প্রীতম বসুর পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল


সাহিত্যের পাঠক কম বেশি সকলেই কিন্তু তার মধ্যেই কেউ কেউ জহুরী তাঁরাও পড়েন সাহিত্য, কিন্তু কেবল গল্পের টান বা ছন্দের তানের আকর্ষণে নয় তাদের নজর চলে যায় সৃজনের অন্দরমহলের দিকে। পুঁথির পাতায়, অক্ষর বিন্যাসে প্রাচীন বা মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রামাণিকতা নিয়ে আলাপ আলোচনায় এগুলি অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠে সে আমরা জানি আর এও জানি সাহিত্যের জহুরীদের এইসব পণ্ডিতি আলোচনা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম পেরিয়ে খুব কমই সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ে। কিন্তু কখনো কখনো একটা ব্যতিক্রম তৈরি হয়ে যায়। প্রীতম বসুর মতো প্রবাসী বাঙালি যখন ডুবুরীর মতো ভাষা সাহিত্যের সেই পণ্ডিতি গবেষণার উপাদানকে ব্যবহার করে রোমহর্ষক এক থ্রিলার তৈরি করে দিতে পারেন পাঁচমুড়ার পঞ্চাননমঙ্গলের মতো উপন্যাসে।
আকর্ষনীয় কাহিনী বিন্যাস নিঃসন্দেহে পঞ্চাননমঙ্গল এর আবিস্কার ঘিরে এখানে দানা বেঁধে উঠেছে, কিন্তু সেটাই এই বইয়ের প্রধানতম আকর্ষণ নয়। আমাদের হারানো অতীতের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, যা ইউরোপের চোখে জগৎ দেখার বাইরের এক নিজস্বতাকে খুলে দিতে চায়, তাকে আমরা এই আখ্যানে পেয়ে যাই। কীভাবে লেখা হত পুঁথি, কেন কাগজ ব্যবহারে আমাদের এখানে অনেক লিপিকরের দীর্ঘদিনের আপত্তি ছিল, তুলোট পাতা আর তালপাতার পুঁথির পার্থক্য কোথায়, কাহিনীর অন্তর্গত উপাদান হিসেবেই প্রীতম আমাদের তা জানিয়ে দেন। তুলে আনেন বাংলা বর্ণমালার বিবর্তন সূত্রটি। এই আখ্যানের অন্যতম প্রধান দুটি চরিত্রই সারা জীবন ধরে পুরনো সাহিত্য নিয়ে দুভাবে কাজ করেন – সদানন্দ ভট্টাচার্য ও হরু ঠাকুর। প্রথমজনের যদি পারিবারিক ব্যবসা ও নেশা আগ্রহের সূত্রে জহুরীর চোখ তৈরি হয়ে থাকে তো দ্বিতীয় জনের রয়েছে পুঁথি নকলের ও পুঁথি দেখার প্রাতিষ্ঠানিক তালিম। সেইসঙ্গে স্বাভাবিক কবিত্ব যা সহজেই ধরে নিতে পারে পুরনো সাহিত্যের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গীটিকে।
বস্তুতপক্ষে হরু ঠাকুরের আড়াল থেকে লেখক প্রীতম বসু নিজেই এখানে একটি পরীক্ষায় নেমেছেন। চর্যাপদের ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মাঝের সময়ের বাংলা ভাষাটি, যার কোনও প্রামাণ্য উপাদান আমাদের হাতে এসে পৌছয় নি অন্ধকার যুগের আড়াল ভেদ করে, সেই ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বাংলাভাষার রূপটি কেমন ছিল। গদ্য আখ্যানের পরতে পরতে মধ্যযুগের পুননির্মিত সেই ভাষায় দীর্ঘ দীর্ঘ পদ্য অংশ মিশিয়ে দেন প্রীতম, বিশেষত কাহিনীর মধ্যভাগ থেকে। আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি দক্ষ আখ্যানকার প্রীতমের মধ্যেই কীভাবে মিশে আছে এক ভাষা গবেষক, ছন্দ বিশ্লেষক নিপুণ কবি।
কুসুম কোঁঅলী তার        ছিন্ডিআঁছে অলঙ্কার
ছিন্ডিআঁছে যত মানভএ।
গোরা তার দেহকান্ত        আনুপাম বীর শান্ত
দীঠি কৈল তারি মন জয়।
ছিন্ন নিচোল ছিন্ন কেশ        দেয়ি আপনা বেশ
ঢাকিলেঁ তিরির লাজ
পুরুষের বসনে        জেন বনদেবী বনে
অপরুব তার দেহসাজ।।
বস্তুতপক্ষে ছিরিছাঁদ এর লেখক প্রীতম বাংলা ও সংস্কৃত ছন্দ নিয়ে কতখানি দক্ষ তার প্রমাণ এই আখ্যানের কয়েকটি চকিত মুহূর্তেও আছে। চর্যাপদের চৌপদীর থেকে বাংলা পয়ারের আদি পর্বের নির্মাণটিই শুধু নয়, সংস্কৃত কয়েকটি ছন্দের নিপুণ বিশ্লেষণ তিনি এখানে তুলে আনেন। এখানে আছে তোটক, তূণক, ভুজঙ্গপ্রয়াত প্রভৃতি ছন্দের দৃষ্টান্ত ও আলোচনা।  প্রীতম একটি প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু উত্তর দেন নি। সংস্কৃতে অন্তমিল নেই, বাঙালি তা পেল কোথা থেকে ? হয়ত মুণ্ডা ভাষার আলোচনা ও বাংলার ওপর তার প্রভাব থেকে এই প্রশ্নের উত্তরের দিকে এগনো যায়। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ
পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গলের কাহিনীটি আকর্ষনীয়। গুডরিডস থেকে তা হয়ত অনেকেই পড়ে নিয়েছেন।
সদানন্দ ভট্টাচার্য পাঁচমুড়ো গ্রামের সঙ্গতিহীন জমিদার। কিন্তু বাংলার প্রাচীন সাহিত্য এবং পুঁথিপাটা নিয়ে ভদ্রলোকের বেশ নাড়াঘাঁটা আছে। বিদেশ থেকে এক ভদ্রলোক আসেন ওঁর কাছে,যাঁর নাম মিঃ ধাড়া। এঁর নাকি লন্ডনে একটা মিউজিয়াম আছে, সেখানে তিনি বাংলা সাহিত্যের পুরোনো সব পুঁথি সংগ্রহ করে রাখেন। এই পুঁথির কাজেই তাঁর এদেশে আগমন এবং সদানন্দ ভটচায্ এর কাছে নাড়া বাঁধা। কালাচাঁদ নামে এক পুঁথি চোর ধাড়াকে চন্ডীদাসের এক নকল পুঁথি বিক্রী করতে এসে সদানন্দের হাতে ধরা পড়ে। সদানন্দ যখন পুঁথির নকলনবীশীর ব্যাপারে জ্ঞান দিতে ব্যস্ত, সেইসময় খবর পাওয়া যায়, পাঁচমুড়ো গ্রামের প্রায় মজে যাওয়া পুকুর চয়নবিলের নীচে থেকে নাকি কিছু পাথর পাওয়া গেছে, যাতে পুরোনো কিসব অক্ষর খোদাই করা আছে। পাথরের ওপর খোদাই করা লেখা পাঠ করে সদানন্দ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন পঞ্চদশ শতাব্দীর বাংলা ভাষায় এক অনন্য রচনার অংশবিশেষ। এই পঞ্চাননমঙ্গলের অস্তিত্ব নাকি অনেকটা নেক্রোনমিকনের মত। আরব মুসলমানদের কাছে এই বই নাকি,‘শয়তানের পুঁথি’? মানে পঞ্চানন মঙ্গল? কিন্তু সেরকম তো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় না বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে! দেখা যায় এই কাব্য মোটেই অন্যান্য মঙ্গল কাব্যের মত গূঢ় জীবনদর্শন বা দেবস্তুতি নয়। এর ছন্দের মধ্যে লুকানো আছে অঙ্ক। গল্প এগিয়েছে এদিক ওদিক করে। কখনো ইতিহাস, কখনো বর্তমানকে ঘিরে। জালালুদ্দিনের সময়ের পঞ্চমুন্ডি গ্রামের ইতিহাসের ওপর ভর করে চলেছে পঞ্চানন মঙ্গল। তাতে যেমন এক বিয়োগান্তক মঙ্গলকাব্য আছে, তেমনি আছে এক অসম্ভব প্রতিভাবান বাঙালী কবিরাজের রচনায় গনিতের সাথে কাব্যের মেলবন্ধন। পড়লে চমৎকৃত হতে হয়। লুপ্ত এক মঙ্গলকাব্য ঘিরে এক অসাধারণ থ্রিলার”
পঞ্চাননমঙ্গল এর কাহিনীর অন্যতম আকর্ষণের দিক প্রাচীন ভারতের গণিত চর্চার মণিমুক্তোগুলিকে তুলে আনতে পারা। যে কৃতিত্ত্ব আমাদের বিজ্ঞানীদের পাওয়া উচিত ছিল, অনেক সময়েই তাঁরা তা পান নি। আর্যভট্ট বা ব্রহ্মগুপ্তদের আবিস্কারগুলি আরবীয় অনুবাদের হাত ধরে পশ্চিমী জগতে পৌঁছেছে। কিন্তু সে ইতিহাসের অনেকটাই আড়ালে ঢাকা। প্রীতম বসু আমাদের সেই ইতিহাস এখানে আখ্যানের ফাঁকে ফাঁকে জানিয়ে দিতে চান। আটশো শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয় পণ্ডিতের হাত ধরে ভারতের সুপ্রাচীন গণিতবিদ্যা পৌঁছোয় বাগদাদের রাজসভায়,আরবিতে অনুবাদ করা হয় সেই পুঁথিগুলির। সেই সূত্রেই পরবর্তীকালে অল-খোয়ারিজমি ‘ভারতের সংখ্যা দিয়ে গণনাপদ্ধতি’ ব্যবহার করে অ্যালগরিদমএর জনক হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে পরিচিত হন (অল-খোয়ারিজম এর অপভ্রংশই আজকের অ্যালগরিদম) আর তারপর নানা আফগানী তুর্কি আরবী শাসক, যাদের অন্যতম বক্তিয়ার খিলজি - ভারতের গর্ব নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তিন মাস ধরে পোড়ান হয় ভারতের মহামূল্যবান পুঁথিসমূহকে, যাতে কিনা ভারতের একান্ত নিজস্ব গণিতবিদ্যা আবিষ্কারের উজ্জ্বল ইতিহাস কালের গর্ভে চিরকালের মতো নিমজ্জিত হয়। আমরা জানতে পারি না অনেক আগেই ভারতে জানা হয়ে গিয়েছিল আলোর গতিবেগের পরিমাপ, 'পাই'-এর মান, অ্যালজেব্রা, ত্রিকোণমিতি, দশমিকের ব্যবহার, তথাকথিত ‘পিথাগোরাসের থিওরেম’ পিথাগোরাসের জন্মের দুশো বছর আগেই।
এই গণিত চর্চার ইতিহাস যেমন আমরা জানি না, ঠিক তেমনি আজকের বাঙালি সেভাবে জানেন ই না আমাদের এই বাংলা নৌ নির্মাণ থেকে কামানের ব্যবহারে কত দক্ষ ছিল। চিনের নৌ নির্মাতারা যেমন আসতেন এই দেশে, তেমনি এদেশের যুদ্ধে প্রথম কামান ব্যবহারের গৌরব যিনি পেয়ে থাকেন সেই বাবর স্বয়ং কীভাবে তাঁর আত্মজীবনীতে বাঙালির কামান চালানোর দক্ষতার প্রশংসা করে গেছেন।
এই লেখা শুধু আমাদের অতীতের জন্য গর্বকেই জাগিয়ে তুলতে চায় না। সেই অতীত কীভাবে আরবীয় তুর্কী মুসলমান শক্তির হাতে ধ্বংস হল সেই মনস্তাপও তৈরি করে। এই জন্যেই এই লেখা নিয়ে সতর্ক হবার অবকাশ আছে। যাতে ইতিহাসের বদলার রাজনীতি, যা আমরা রাম মন্দির আন্দোলনে বাবরি ভাঙার ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি, তা এ থেকে জন্ম নিতে না পারে। সম্ভবত লেখকও এই বিপদটি সম্বন্ধে সতর্ক। তাই আমরা দেখি পঞ্চানন এর মন্দিরটি একদিনের মধ্যে অনেক সহকারী জুটিয়ে তৈরি করে দেন যে কুশলী কারিগর, তিনিও এক মুসলমান। এবং তার পূর্বপুরুষদের মন্দির ভাঙার প্রায়শ্চিত্ত যেন তিনি এই কাজের মধ্যে দিয়ে করে যান। পারিশ্রমিক গ্রহণ করেও তা ফিরিয়ে দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের নজির রাখেন।
বাঙালির অতীত মনন চর্চার ইতিহাস এখানে আছে, আছে বিদেশী শক্তির হাতে পর্যদুস্ত হয়ে সেই ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলার মনস্তাপও। আর রয়েছে নিজের শিকড়ে ফেরার টান। মন্দিরের চাতালে কবিগান, ঝুমুর গান, আখড়ার সংস্কৃতি ফিরে পাওয়ার আগ্রহ। বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এমন নান্দনিক উপস্থাপণা বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে কমই হয়েছে।