Tuesday, October 02, 2018

এরিক হবসবম


বিশ শতকের অন্যতম খ্যাতনামা ঐতিহাসিক হিসেবে এরিক হবসবম গোটা দুনিয়ার সব মহলেই নন্দিত ছিলেন। এমনকী যারা মার্কসবাদের সমর্থক নন, তাঁরাও এই আনখশির মার্কসবাদী ঐতিহাসিকের অসামান্য অবদানকে মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন। হবসবম জন্মেছিলেন রুশ বিপ্লবের বছরে, ১৯১৭ সালে। তাঁর পরিবার তখন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে। হবসবমের জন্মের দু বছর পর তাঁরা প্রথমে চলে আসেন জার্মানীর ভিয়েনায়, অতঃপর বার্লিনে। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর হবসবম চলে আসেন ইংলণ্ডে এবং বাকী জীবন সেখানেই থাকেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পি এইচ ডি করেন, গবেষণার বিষয় ছিল ফেবিয়ান সমাজ। সারা জীবন ইতিহাসের অধ্যাপণার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী। ১৯৩৬ সালে তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং ১৯৯১ সালে পার্টি বিলুপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি এর সভ্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরীতে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর তাঁর বেশিরভাগ সহযোগী বন্ধু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করলেও তিনি পার্টির সাথেই যুক্ত থাকেন। পাশাপাশি সোভিয়েত রাশিয়ার স্খলনগুলি নিয়েও তিনি সে সময় সোচ্চার হন। হাঙ্গেরী এবং পোলাণ্ড এর বিদ্রোহকে সমর্থন করে তিনি একে বলেছিলেন, ‘আমলাতন্ত্র ও ছদ্ম কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবীদের বিক্ষোভ’।
প্রি ক্যাপিটালিস্ট ইকনমিক ফর্মেশন, ইণ্ডাস্ট্রি অ্যাণ্ড এম্পায়ার, রিভোলিউশনারিস, নেশনস অ্যাণ্ড ন্যশানিলজম, অন হিস্ট্রি বা সাম্প্রতিকালে লেখা ইন্টারেস্টিং টাইমস : এ টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরী লাইফ, গ্লোবাইলাইজেশন, ডেমোক্রেসি অ্যাণ্ড টেররিজম, হাউ টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড এর মতো বহু সাড়া জাগানো বইয়ের লেখক হলেও হবসবম সারা বিশ্বের মননশীল পাঠকের কাছে বিখ্যাত হয়ে আছেন চার পর্ব জুড়ে বিশ্লেষিত ইউরোপ তথা বিশ্বের আধুনিকতার ইতিহাসের অনবদ্য আখ্যানের জন্য।
এজ অব রিভোলিউশন (১৭৮৯-১৮৪৮), এজ অব ক্যাপিটাল (১৮৪৮-১৮৭৫), এজ অব এম্পায়ার (১৮৭৫-১৯১৪), এজ অব এক্সট্রিমস (১৯১৪-১৯৯১) সম্মিলিতভাবে আধুনিক সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্য হিসেবেই পরিগণিত হয়।
এজ অব রিভোলিউশন ফরাসী বিপ্লব ও ইংলণ্ডের শিল্প বিপ্লবের সূত্র ধরে আধুনিক ইউরোপের বহুস্তরিক নির্মাণপর্বের শুরুর দিনগুলোর অসামান্য ভাষ্য। আমরা স্মরণ করতে পারি বইয়ের প্রথম চমকপ্রদ বাক্যটি। ‘প্রথমেই নজরে পড়ে ১৭৮০ র দশকের পৃথিবী আমাদের আজকের পৃথিবীর তুলনায় একইসঙ্গে ছিল অনেক ছোট এবং অনেক বড়’। অতঃপর হবসবম আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে দেখান ভৌগলিক সীমা সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রেক্ষিতেই হোক বা লোকসংখ্যার নিরিখে, কেমন ছোট ছিল সে সময়ের পৃথিবী। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার তখনকার অপ্রতুল অবস্থা এই ছোট পৃথিবীকেই আজকের তুলনায় বড় করে দেখাত। হবসবম আমাদের দেখান শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে ইউরোপ তথা পৃথিবী কীভাবে নতুন নতুন ভৌগলিক ভূখণ্ডের সাথে নিবিড়ভাবে ক্রমশ পরিচিত হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে ধারণাগত আঞ্চলিক সীমা, আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব বিকাশ কীভাবে দূরকে করে তুলছে নিকট। শিল্প বিপ্লব এবং ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস, বিশ্বজোড়া তার তাৎপর্য, যা আগামী দিনগুলিকে সারা বিশ্বের জন্যই বদলে দেবে, তাঁর আসামান্য ভাষ্য রচনার পর হবসবম মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাস আলোচনা করেন। বিজ্ঞান ও সাহিত্য সংস্কৃতির অসামান্য বিকাশের পাশাপাশি গরীব শ্রমজীবী মানুষের একটি শ্রেণি হিসেবে কীভাবে তৈরি হয়ে উঠছে সে কথাও তোলেন হবসবম।
এজ অব ক্যাপিটাল বইটি ইউরোপীয় পুঁজিবাদের দুর্মর বিকাশ ও বিশ্বজোড়া তার প্রভাবের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে বারবার এসেছেন মার্কস, এসেছে তার ক্যাপিটাল ও অন্যান্য বইয়ের প্রসঙ্গ। হবসবম আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মার্কস এবং এঙ্গেলস যেমন বলেছিলেন, ‘ ইউরোপ একটা ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত’, তেমনি অন্য অনেকেও কেমন এরকমটাই বলছিলেন, যদিও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে। ১৮৪৮ এ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো লেখার বছরেই ফরাসী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিক আলেক্সি দ্য তকুইভিল সবার মনের ভাব প্রকাশ করছিলেন, ‘আমরা কি একটা আগ্নেগিরির ওপর দাঁড়িয়ে নেই? আমরা কি বুঝতে পারছি না জগৎটা কাঁপছে? বিপ্লবের হাওয়া বইছে, দিগন্তে দেখা যাচ্ছে ঝড়।’ পুঁজিবাদের বিকাশের পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ ও প্রতিস্পর্ধিতার গৌরবময় নানা প্রচেষ্টা, দ্বন্দ্বের ঝোড়ো হাওয়ার ইতিহাস এই বইটিতে হবসবম তুলে আনেন।
এজ অব এম্পায়ার বইটি শুরু হয় ১৮৫৭ র অর্থনৈতিক মন্দার পর্বটি দিয়ে। ইউরোপীয় পুঁজিবাদ দ্রুতই এই মন্দার দশা কাটিয়ে ওঠে, কিন্তু এই সময়েই আমেরিকান ও জার্মান অর্থনীতি ব্রিটিশ অর্থনীতিকে টেক্কা দিতে থাকে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ পণ্য চলাচলকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়, বাড়তে থাকে জীবনযাত্রার মান। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং দেশগুলির ভেতর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে অসাম্য পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর উপনিবেশ বাড়ানোর চেষ্টা। আপাত শান্তির পরিবেশে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলি অস্ত্রসম্ভার বাড়িয়ে যেতে থাকে। সময়ের মধ্যে নিহিত এইসব মৌলিক দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো এক তীব্র সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। লেনিনের মত অনেকেই মনে করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে। হবসবম স্বীকার করেন পুঁজিবাদ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। তবে তা পারলেও অষ্টাদশ শতকের শেষে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের উত্তরাধিকারজাত যে চরিত্র নিয়ে সে পথ চলা শুরু করেছিল তার সে চরিত্র বহুলাংশে বদলে গেছে। অনেক সমাজতান্ত্রিক দাবীকে নিজের মধ্যে অঙ্গীভূত করে ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ নামক এক ব্যবস্থার জন্ম দিতে সে বাধ্য হয়েছে।
এজ অব এক্সট্রিমস প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের সময়কাল থেকে ১৯৯১ এ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অবসানপর্ব পর্যন্ত সময়ের দলিল। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের দ্বন্দ্বর বিশ্বজনীন চেহারা ছাড়াও উপনিবেশগুলেতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে সমাজতন্ত্র, তার নির্মাণ, বিকাশ, জটিলতা, পুঁজিবাদের সাথে তার দ্বন্দ্ব ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন নিশ্চিতভাবেই এই বইয়ের মূল মেরুদণ্ড। হবসবম মনে করেছেন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্র শুরু থেকেই সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মৌলিক কিছু মতাদর্শের সাথে সংঘাতে উপনীত হয়। সমাজতন্ত্রের মধ্যে নিহিত গণতন্ত্রের প্রশ্নটিকে অনেক সময়েই অবহেলিত থাকতে হয়েছে। যুগস্লাভিয়া, আলবেনিয়া বা চিনের মত অনেক দেশের বিপ্লব শেষপর্যন্ত সোভিয়েত পরামর্শের চেয়ে ভিন্নপথে হেঁটেই অর্জিত হয়েছে। যেমন মাও স্টালিন নির্দেশিত পন্থাকে অতিক্রম করে নিজের দেশকালের অনুগ নিজস্ব পথ তৈরি করেছিলেন। কমিউনিস্টদের নিজস্ব কার্যক্রম সীমিত রেখে ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চেই সব প্রয়াস উন্মুক্ত করার কমিন্টার্নপ্রেরিত নির্দেশিকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনে অনেক সময়েই ভালো ফল দেয় নি।
এরিক হবসবম এর সব মতামত যে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে, তা অবশ্যই নয়। বস্তুত জ্ঞানচর্চার জগতে, বিশেষত সমাজবিজ্ঞান চর্চায় শেষকথা বলে কিছু হয় না। কিন্তু কোন কোন নিপুণ ভাষ্যকার যখন তাঁর বিশ্লেষণের সাহায্যে একটা বিষয় বা পর্বকে আলোকিত করে তোলেন, তখন চিন্তা চর্চার অনেকগুলো দুয়ার খুলে যায়। ইতিহাসকার বা সমাজ বৈজ্ঞানিকের স্বার্থকতা সেখানেই আর আমাদের শ্রদ্ধেয় এই ঐতিহাসিক তাঁর লেখা একের পর এক বইতে সেই কাজটা অনন্য দক্ষতায় সম্পন্ন করে সমাজ বিজ্ঞান চর্চার জগতে অতি বিশিষ্ট আসন লাভ করেছেন।

ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘লো ল্যাণ্ড’ নিয়ে কথাবার্তা


সত্তর দশকে নকশালবাড়ি আন্দোলন একটা তরঙ্গ তুলেছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার আগেই খানিকটা তত্ত্ব-প্রয়োগের নিজস্ব জটিলতায় এবং মূলত রাষ্ট্রশক্তির দানবীয় আক্রমণের সামনে তার প্রথম পর্বটির অবসান ঘটে। আন্দোলন এবং সংগঠন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষাটা মরে নি। আশি এবং নব্বই এর দশকে বিহারে লিবারেশন গোষ্ঠী এবং অন্ধ্রপ্রদেশে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী বড় মাত্রায় জনসমর্থন অর্জন করে এবং নকশালবাড়ির রাজনীতিকে অনেকাংশে স্মৃতি থেকে সত্তায় ফিরিয়ে আনে। সি পি আই(মাওবাদী) গঠনের পর তা ছত্তিশগড়ে কিছু চমকপ্রদ সামরিক হানাদারি চালায় রাষ্ট্রের ওপর, তৈরি করে তথাকথিত রেড করিডর এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একে ‘আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার ভয়াবহতম চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। এই নতুন তরঙ্গের ঢেউ জনযুদ্ধ গোষ্ঠীর মাধ্যমে নয়ের দশকের শেষেই পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল, কিন্তু তা সর্বস্তরে বিরাট আলোড়নের কেন্দ্রে আসে একুশ শতকের প্রথম দশকের শেষ কয়েক বছরে। লালগড় আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূলত এই সামনে আসা। এই দ্বিতীয় তরঙ্গের পশ্চিমবঙ্গ অধ্যায়টি চার দশক আগের প্রথম অধ্যায়টির মতো আবারো রাষ্ট্রশক্তির দমনের মুখোমুখি হয় এবং তাদের অন্যতম রাজনৈতিক মুখ কোটেশ্বর রাও বা কিষাণজীর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এই তরঙ্গের সমাপ্তি হয়। কোটেশ্বর রাও এর হত্যাকাণ্ডের সময়কাল ছিল ২০১১ র নভেম্বর। নকশালবাড় আন্দোলনের প্রথম প্রবের মতো এই দ্বিতীয় পর্বটিও ছিল সংক্ষিপ্ত। কিন্তু প্রথম পর্বের উন্মাদনা সঞ্চার করা বা জন জাগরণের কাছাকাছি পৌঁছানো তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বিশেষ করে ছাত্র যুবদের মধ্যে আলোড়ন প্রথম পর্বের তুলনায় ছিল নেহাৎই সীমিত।
কেন এরকম পরিবর্তন ? এটা কি আন্দোলনের ভেতরকার উপাদানের বিরাট পার্থক্যের প্রতিফলন ? নাকি বদলে যাওয়া ছাত্র যুব মানসিকতা এর পেছনে ক্রিয়াশীল ? আজকের যুবসমাজ কীভাবে দেখে এই সমস্ত বিপ্লব প্রচেষ্টাকে ? সেই দেখার নিশ্চিত কোনও একটি ধারা নেই। আছে অনেক রকম দৃষ্টিকোণ। সেই দৃষ্টিকোণের নানাত্বকে বোঝা দরকার। শিল্পে সাহিত্যে ধরা পড়ে এগুলি। নকশালবাড়িকে ঘিরে প্রথম পর্বের অবসানের পর এক ধরণের গল্প উপন্যাস লেখা হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীর হাজার চুরাশির মা, নবারুণ ভট্টাচার্যের হারবার্ট, যুদ্ধ পরিস্থিতি, সমরেশ মজুমদারের কালবেলার মত জনচিত্তজয়ী আখ্যানগুলি নকশালবাড়ির বিপ্লবী রাজনীতিকে দেখার প্রশ্নে অনেক আবেগ তাড়িত। কিন্তু এই সময়ে নকশালবাড়ি নিয়ে যে সমস্ত আখ্যান লেখা হচ্ছে, বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কেউ যদি তা লেখেন – সেখানে কীভাবে ধরা পড়ে এই আন্দোলন ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই মনে হল বোঝা দরকার ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘লো ল্যাণ্ড’কে। ঝুম্পার মতো নবীন প্রজন্মের লেখিকা, যিনি এখনকার কসমোপলিটন শহরের সামাজিকভাবে অগ্রসর যুব সমাজের স্বচ্ছন্দের ভাষা ইংরাজীতেই লেখেন তার কাহিনী – তিনি কীভাবে দেখছেন নকশালবাড়ি ফেনোমেননটিকে ? এই জিজ্ঞাসা থেকেই আমাদের ‘লো ল্যাণ্ড’কে দেখার একটা আগ্রহ তৈরি হয়।



ঝুম্পা লাহিড়ীর লো ল্যাণ্ড : একটি হত্যাকাণ্ড ও তার ছায়া মানব মানবীরা


ঝুম্পা লাহিড়ীর লো ল্যাণ্ড বা নাবাল জমি ইতিহাসের এক বিশেষ মুহূর্ত কীভাবে পরিবারের ওপর নিবিড় ছায়া ফেলেছে তার অন্তরঙ্গ কাহিনী। চল্লিশের দশকে কোলকাতায় জন্ম নেওয়া দুই ভাই ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে তাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে। বড় সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর দু বছরের ছোট উদয়ন পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে শুরু করে প্রেসিডেন্সি কলেজে। ষাটের দশকের শেষের দিকের সেই সময়টা নকশালবাড়ি আন্দোলনের উত্থান বিকাশের সময়। সুভাষ আন্দোলনে অংশ নেয় নি, হয়ত একে খুব সমর্থনও করে নি। আন্দোলন শুরুর দুবছর পর নতুন পার্টি সি পি আই (এম এল) গঠনের সময় সে পড়াশুনো করতে পারি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ছোট ভাই উদয়ন ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে যায় আন্দোলনের সঙ্গে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের নানা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, নানা ভাষ্য, কার্যকলাপের বিবরণ এখানে আছে। ঝুম্পা লাহিড়ী আন্দোলনকে চুলচেরা যুক্তিকাঠামোয় ঠিক ভুলের নিরিখে বিচার করতে যান নি। সেটা এই আখ্যানের লক্ষ্যবিন্দুও ছিল না। আখ্যানকার চেয়েছিলেন এই আন্দোলনের সূত্রে একটি পরিবারের বিভিন্ন চরিত্র যে সমস্ত ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেল, যে সমস্ত সম্পর্কের ওঠাপড়া প্রত্যক্ষ করল, তার এক অন্তরঙ্গ বয়ান রচনা করতে।
চারু মজুমদারের আহ্বানে উদ্দীপ্ত কোলকাতার ছাত্রযুবরা তখন নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেবার স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন দেখছে সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার। আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই যে সমস্ত রণনীতি চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন পার্টি গ্রহণ করে তাকে ঢুকে পড়ে ব্যক্তিহত্যা। এলাকার সাধারণ পুলিশকর্মী থেকে বিরোধী পার্টির কর্মী – লক্ষ্যবস্তু বানানো হতে থাকে নির্বিচারে। নানা নাশকতা ঘটানো হয়, অনেক নাশকতার পরিকল্পনা চলতে থাকে। এর বিপরীতে রাষ্ট্রের দিক থেকেও নেমে আসে নির্মম দমন পীড়ণ। যে ঘটনাটির স্মৃতি এই উপন্যাসে সারাক্ষণ তার ছায়া বিস্তার করে থেকেছে, নিজেদের বাড়ির কাছের নাবাল জমিটিতে উদয়নের হত্যা – সেটি এরকম অসংখ্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরই একটি। সুভাষের কাছে গৌরীর বর্ণনা সূত্রে ঘটনাটির অনুপুঙ্ক্ষ বর্ণনা এসেছে উপন্যাসে।
ঘটনার আগে থেকেই অবশ্য উদয়ন এই ধরণের কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল। একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর ছাড়া পেলেও সে জানত পুলিশের নজর তার ওপর থাকবেই। টলি ক্লাবে নাশকতার পরিকল্পনাকারী বা এলাকারই এক পুলিশকে হত্যার অন্যতম ক্রীড়নককে গোয়েন্দা ও পুলিশ বিভাগ স্বাভাবিকভাবেই নজরে রাখত। সমস্তকিছু বিস্তারিতভাবে না জানলেও মা বাবা বা স্ত্রী গৌরী অনুমান করত বিপদের গভীরতা আর তাই সকলের মিলিত সিদ্ধান্তে বাড়িতেই আত্মগোপন করে ছিল উদয়ন। গৌরীকে পালানোর সম্ভাব্য এলাকা বা পথও জানিয়ে রেখেছিল আগে থেকেই। শেষপর্যন্ত পুলিশ যেদিন এল বাড়ির পাশের জলা নাবাল জমিটিতে আশ্রয় নিলেও শেষরক্ষা হয় নি। উঠে আসতে হয়েছিল কচুরীপানা মাখা অবস্থায় জখম ব্যাণ্ডেজ বাঁধা একটি হাতে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। বাবা মা স্ত্রী ছাদ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অধ্যায়টুকু। গ্রেপ্তারীর নাটক আর তারপর ঠান্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে হত্যা। লাশ নিয়ে পুলিশ ভ্যানের চলে যাওয়া। উদয়নের মৃতদেহ আর কোনদিনই ফেরৎ পাওয়া যায় নি। রাষ্ট্রও স্বীকার করে নি এই ধরণের হত্যাকাণ্ডের কথা।
উদয়নের মৃত্যুর খবর পেয়ে দাদা সুভাষ আমেরিকা থেকে ফেরে। প্রথম আলাপ হয় গৌরীর সাথে। মায়ের থেকে জানতে পারে গৌরী উদয়নের সন্তানের মা হতে চলেছে। গৌরী যে পরিবারে গ্রহণযোগ্য হচ্ছিল না উদয়নের মৃত্যুর পর, সেটা সুভাষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। গৌরী ও তার আগত সন্তানের কথা ভেবে, হয়ত উদয়নের কথা ভেবেও সুভাষ গৌরীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। সুভাষের বাবা মা খুশি না হলেও গৌরী শেষপর্যন্ত আমেরিকা চলে আসে। সেখানেই সুভাষের সঙ্গে শুরু হয় তার এক জটিল দাম্পত্য। জন্ম নেয় কন্যা বেলা, যে জীবনের প্রথম তিনটি দশক নানা উত্থান পতনের মুহূর্তেও কখনোই জানতে পারে নি সুভাষ তার জন্মদাতা বাবা নয়, পালক পিতা।
বস্তুতপক্ষে নকশালবাড়ি আন্দোলন বা উদয়ন হত্যাকাণ্ডের ছায়ার মধ্যে এই আখ্যান বরাবরই ঘোরাফেরা করেছে এবং টালিগঞ্জ থেকে হাজার হাজার মেইল দূরে আমেরিকার পূর্বপ্রান্তে গিয়েও সেই ছায়া থেকে উপন্যাসের প্রধান পাত্রপাত্রীরা বেরোতে পারে নি। নিশ্চিতভাবেই ঝুম্পা লাহিড়ী ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডটির ছায়া আখ্যানে বরাবর রেখেছেন, কিন্তু কোনও সস্তা মেলোড্রামায় কাহিনীকে কখনো আক্রান্ত হতে দেন নি।
এই নিরিখে গৌরী চরিত্রটিই সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ ছিল এবং উপন্যাসে সবচেয়ে বহুকৌণিক অবস্থান থেকে তাকেই নির্মাণ করেছেন আখ্যানকার। সুভাষ প্রত্যক্ষত উদয়ন এবং তার হত্যাকাণ্ডের ছায়ার বাইরে আসতে চেয়েছিল, যদিও উদয়ন বা আশৈশবের ছায়াসঙ্গীকে বিস্মৃত হয়ে নয়। সমস্ত স্মৃতিকে নিয়েই সে গৌরীর স্বামী এবং পালক পিতার বদলে পিতা হয়ে উঠতে চেয়েছিল। ঝুম্পা লাহিড়ী এই বইটি সম্পর্কে নিজেও বলেছিলেন পরিবারকে কেন্দ্র করে কিছু প্রশ্ন এবং নিরীক্ষার সামনে তার চরিত্রদের তিনি দাঁড় করিয়েছেন এখানে। আমরা আখ্যান বিশ্লেষণ করেই বুঝি বা বেলার আচরণে – পিতৃত্বের প্রশ্নে সুভাষ এর আন্তরিকতা কোনও প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়বে না। এমনকী প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছে সুভাষ শেষপর্যন্ত যখন বেলার মা গৌরীকে ডিভোর্স করে নতুন জীবন সঙ্গিনী খুঁজে নিচ্ছেন, তখন বেলার তাতে সাদর সম্মতি। একই বাড়িতে সে তার মেয়েকে নিয়ে থাকছে যে বালিকাকেও জানানো হয়েছে তার দাদুর আসন্ন বিয়ের খবর।
কিন্তু এই বেলাই মেয়ে হয়েও কঠোরতমভাবে প্রত্যাখ্যান করে নিজের মাকে। জন্মদাতা পিতার মৃত্যুর স্মৃতিকাতরতাই গৌরীর সব ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ – এটা বেলা মনে করে নি। মেয়ে বেলাকে নাবালিকা অবস্থায় ছেড়ে, স্বামী সুভাষকে ছেড়ে গৌরীর চাকরী নিয়ে ক্যালিফর্ণিয়ায় চলে যাওয়া এবং কোনও যোগাযোগ না রাখাকে সে প্রেমিক স্বামী উদয়নের ঘটনাবলীর যৌক্তিক পরম্পরা বলে স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত ছিল না।
গৌরীর চলে যাওয়া কতটা উদয়নের স্মৃতির বাইরে বেরনোর অপারগতা থেকে আর কতটা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে নিজের মতো গড়ে পিঠে নেবার – এ প্রশ্ন পাঠককে বিদ্ধ করবেই। গৌরী যদি রোড আইল্যাণ্ডের বাড়িতে বিষণ্ণ একাকিত্বে নিজেকে আলাদা করে নিত তবে কি বাঙালি সাবেকিয়ানার মন আস্বস্ত হত ? প্রশ্নটা অবশ্যই ফেলে আসা মৃত স্বামীর জন্য গোপন অশ্রুবর্ষণ এর পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয়তা বনাম পাশ্চাত্যের বন্ধনমুক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার নয়। প্রশ্নটাকে ঝুম্পা লাহিড়ী দ্বিতীয় প্রজন্মের পাশ্চাত্যবাসী হিসেবে সেভাবে দেখতেও চান নি। প্রশ্নটা তার কাছে আমাদের সরল প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের বিভাজন ছকে ধরা দেবার কোনও কারণ ছিল না, কারণ সেরকম ছক আমাদের কল্পনা নির্মাণের বাইরে বাস্তবে অবস্থান করেও না। ঝুম্পা পরিবার, মায়ের দায়িত্ব এই প্রশ্নগুলিকে অবশ্যই গৌরীর জীবন বিশ্লেষণের সূত্রে তুলতে চেয়েছেন এবং এই প্রশ্নগুলি যে কোন সমাজের কিছু মৌলিক বিষয় হিসেবেই অবস্থান করে, প্রাচ্য পাশ্চাত্য বিপরীত দৃষ্টিকোণ সেখানে খোঁজার কোনও মানে হয় না।
গৌরীর স্বাধীন জীবন বেছে নেওয়া, তার সমকাম ও বিপরীতকাম সহ বিভিন্ন ধরণের যৌন ও যৌথ যাপনকে অবশ্যই ঝুম্পা কোনও নীতির প্রশ্নে দেখতে চান নি, দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন পাশ্চাত্যবাসী আখ্যানকারের সেরকম দেখার চোখ থাকার কথাও নয়। আমাদের কাছে আখ্যানকার গৌরীকে সমস্যায়িত করেন তার যৌন স্বাধীনতাকে বেছে নেবার সূত্রে নয়, তার শিশু সন্তান এবং পরিবারের প্রতি দায়হীন স্বার্থপরতার জন্য। পশ্চিমী সমাজতত্ত্বে অনভিজ্ঞ আমাদের কাছে পরিবার ও সন্তানের দায় দায়িত্বের নৈতিক অবস্থান এর মানদণ্ড বা ভারসাম্য বিন্দুটির অবস্থান অবশ্যই খুব স্পষ্ট নয়, তবে ঝুম্পার ট্রিটমেন্ট থেকে মনে হয় মৌলিক কিছু দায়বদ্ধতার থেকে, পিতৃত্ব মাতৃত্ব (ঝুম্পা সাক্ষাৎকারে পেরেন্টহুড শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, যার প্রতিশব্দ যোজনা মুশকিল) সংক্রান্ত দায় দায়িত্ব থেকে কোনও সমাজই সেভাবে মুক্ত নয়। গৌরী এই দায়গুলি গ্রহণ করে নি শুধু তাই নয়, এই দায় গ্রহণে তার অপারগতার কথা জানানোর প্রয়োজনও সে বোধ করে নি। মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগহীনতায় তার অপরাধবোধ নিশ্চয়ই কার্যকরী হয়েছে, কিন্তু তা তার দায়িত্বহীনতাকেই বাস্তবে বহুগুণিত করেছে। যে একসময় সুভাষের মর্মব্যথার কেন্দ্র ছিল, নিস্পৃহ দাম্পত্যের যন্ত্রণা দেওয়া সত্ত্বেও সুভাষের দিক থেকে ভালোবাসার সঙ্গিনী ছিল, সেই ক্রমশ হয়ে দাঁড়ালো তার বীতরাগ আর ঘৃণার পাত্রী। এই রূপান্তরে অবশ্যই গৌরীর দায় ছিল।
এতদস্বত্ত্বেও গৌরীর জীবনবৃত্তের নির্বাচনকে উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা স্বেচ্ছাবিহারিণী দায়হীন স্বার্থপরতার ছকে ব্যাখ্যা করা অবশ্যই অতি সরলীকরণ হবে এবং আখ্যানকার ঘটনা সন্নিবেশে বা আখ্যানের পরতে এমন কোনও সরলীকরণের প্রশ্রয় রাখেন নি। যে মানসিক প্রতিকূল পরিবেশে সে তার পড়াশুনোকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা বিদ্যাচর্চায় তাঁর ঐকান্তিক আগ্রহেরই সূচক। আখ্যানের শেষপর্বে উদয়ন গৌরী প্রেমপর্বের কিছু মুহূর্তকে যখন ফিরিয়ে আনেন ঝুম্পা তখন আমরা উদয়নের চোখেও পাঠে একান্ত আসক্তা গৌরীকেই দেখতে পাই। রোড আইল্যাণ্ডে দর্শনের ক্লাসে তার প্রথমদিকে চলে যাওয়াটা দুঃসহ একাকীত্ব কাটানোর এক প্রয়াসই ছিল। প্রেসিডেন্সীর একদা মেধাবী এই ছাত্রীটি সন্তানের জন্মের পরে বিদ্যায়তনিক সেই পরিধি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় নি। কোনও নারীবাদী পাঠ কি এই প্রশ্ন তুলতে পারে না ব্যাপ্ত সুযোগের সদব্যবহারের তাগিদে ক্যালিফোর্ণিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে গৌরীর চলে আসাটাকে এত নেতিবাদী দৃষ্টিকোণে দেখার কারণ কি ? পরিবার ছেড়ে দেশ ছেড়ে সুভাষের আমেরিকা পাড়ি দেওয়ায় তো প্রথমে পারিবারিক, বিশেষ করে মায়ের গর্বই ধ্বনিত হয়েছিল। পরে মা বাবার কাছে না ফেরা সুভাষ তো সেভাবে ধীকৃত নন, অন্তত গৌরীর মত নন কোনওভাবেই। বাবা মার প্রতি ‘দায়বদ্ধতা’র অভাব কি ভাইয়ের মেয়ের পালক থেকে প্রকৃত পিতা হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে শেষমেষ স্খলিত হয়ে গেছে ? যা গৌরীর ক্ষেত্রে ঘটে নি ?
গৌরীর যন্ত্রণাকে কোনও সময়েই অবশ্য মুছে যেতে দেখি নি এবং ক্যালিফোর্ণিয়া বাস পর্বে বিভিন্ন যৌন ও যৌথ জীবন যাপনের পর্বে সে কতটা খুশি কতটা নিস্পৃহ বা কতটা বীতস্পৃহ তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, হয়ত গৌরীর নিজের কাছেও নয়। বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্রে সাফল্য নিশ্চিত তার আকাঙ্ক্ষিত ছিল, কিন্তু সেটি যে চরম কোনও প্রাপ্তি তার ক্ষেত্রে হতে পারে নি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না। বিশেষত দশকের পর দশক যে সুভাষের সঙ্গে মেয়ে বেলার সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না, তাদের থেকে প্রত্যাখ্যানের স্পষ্ট উচ্চাররণগুলির মুহূর্তে, সে নিজের স্থিতিকে হারিয়ে ফেলেছিল। তখন একই সঙ্গে সে যেন স্মৃতি অতীত ভবিষ্যৎ যাবতীয় সম্ভাবনা সহ সব হারানো একজন। নিজের কাছে গৌরীর হারানো প্রাপ্তির হিসাবটা কি দাঁড়াল সেটাই যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তখনই আবার কন্যার থেকে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার ক্ষীণ আভাস নিয়ে এলো এক বার্তা আর সেটাই কি উদয়নের সঙ্গে সম্পর্ক শুরুর স্মৃতির আবহে প্রত্যক্ষভাবে ফিরে গিয়ে তাকে ভবিষ্যতের বাকী দিনগুলোর জন্য স্মৃতিতে আশ্রয় নেবার প্রেরণা দিল ? নিশ্চিতভাবে প্রশ্নগুলির নির্দিষ্ট সর্বসম্মত কোনো উত্তর হয় না এবং দেশকাল ব্যক্তিমানস ভেদে এ নিয়ে বহু অবস্থানই স্বাভাবিক। সমস্যাটিকে জটিলতায় ধরতে চেয়েছেন আখ্যানকার; ইতিহাসের অভিঘাত, পরিবার, পেরেন্টহুড, স্বাধীনতা, দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা, একাকিত্বের বহুকৌণিক প্রশ্নগুলিকে রাখতে চেয়েছেন ভাবনা চিন্তার নানাত্বকে সামনে আনার জন্য - আর তাতে তিনি বিশেষভাবেই সফল।